অদিত্য রাসেল: এবারও শীত মৌসুমে অতিথি পাখির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ বিলাঞ্চল সিরাজগঞ্জের চলনবিল।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধ চলনবিলে মিঠা পানির মাছসহ বিভিন্ন খাবারের সন্ধানে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে অতিথি পাখিসহ রং-বেরঙের নানা প্রজাতির পাখি। বিলে পাখিদের কোলাহল, কলরব, ডানা মেলে অবাধ বিচরণে সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুরো চলনবিল এলাকাতেই এখন অতিথি ও দেশি পাখির আগমণ দৃষ্টি কাড়ছে মানুষের।
রাজশাহী বিভাগের ৬ জেলার ১ হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ছিলো চলনবিল। বর্তমানে সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোরের তিন জেলার ১০টি উপজেলার ৬২টি ইউনিয়নের ১ হাজার ৬০০ গ্রাম নিয়ে বৃহত্তর চলনবিল। বিলে রয়েছে ২১টি নদ-নদী, ৭১টি নালা-খাল ৯৩টি ছোট বিল। চলতি মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলে খাবারের সন্ধানে বক, ইটালি, শর্লি, পিয়াজ খেকো, ত্রিশুল, বাটুইলা, নারুলিয়া, লালস্বর, কাঁদোখোচা, ফেফি, ডাহুক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামকৈলসহ বিভিন্ন নামের অতিথি পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। স্থানীয়রা জানান ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই সকল পাখি চলনবিলের বিভিন্ন মাঠে ও গাছে অবস্থান করে। সকাল থেকেই খাবারের খোঁজে ভিড় করে বক, বালিচোরা, পানকৌড়ি, রাতচরাসহ নানা প্রজাতির পাখি। অবশ্য কিছু দেশি প্রজাতির পাখি সব সময় থাকে এই বিলে।
স্থানীয়রা জানান, বর্তমানে পাখি প্রেমিরাও হরেক রকম পাখি দেখতে আসছেন এ বিলে। চলনবিলে সাধারণত রাতচরা, হারগিলা, ভাঁড়ই, ছোট সারস, বড় সারস, কাঁদোখোচা, নলকাক, ডাহুক, হুটটিটি, চখাচখি, বুনোহাঁস, বালিহাঁস, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখা যায়। তবে এ বছর বালিহাঁস, বক ও রাতচরা প্রজাতির পাখির বেশি দেখা মিলছে। কিন্ত এক শ্রেণির অসাধু পাখি শিকারি সুযোগে জাল ও খাঁচার মাধ্যমে অতিথি পাখি শিকার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তাড়াশের তালম গ্রামের বাসিন্দা শাকিল আহম্মেদ বলেন, প্রশাসন ও পরিবেশ কর্মীদের সচেতনতায় পাখি শিকার অনেকটাই বন্ধ হওয়ায় আগের চেয়ে বিলে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। তবে কিছু অসাধু শিকারি এখনও রাতের বেলায় পাখি শিকার করছেন। এসব বন্ধের দাবি জানান তিনি।
চলনবিলে পাখি দেখতে ও ছবি তুলতে আসা সজল ব্যাপারী ও সামিউল ইসলাম নীরব জানান, তারা শাহজাদপুরের কৈয়জুড়ি গ্রাম থেকে এসেছেন। শীতের এই মৌসুমে প্রতি বছরই পাখি দেখতে চলনবিলে আসেন। চলনবিলে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে ভালো লাগে।
চলনবিল জীববৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত চলনবিলে পাখির বিচরণ আর আগের মত নাই। চলনবিলে আগের মত দীর্ঘসময় পানি থাকে না। এছাড়া কৃষি আবাদে যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার করায় পাখিসহ বিলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খাল খননের পাশাপাশি বিলের নিচু এলাকায় মাছ ও পাখির অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরী।
তিনি বলেন, আমরা মূলত পাখি শিকারিদের নিষেধ ও পাখি অবমুক্ত করে থাকি। এতে পাখি শিকারিরা ততোটা ভয় পায় না। কয়েক বছরে প্রায় দুই হাজারের বেশি শিকার করা পাখি উদ্ধার করে অবমুক্ত করেছি। প্রশাসন এ বিষয়ে একটু নজর দিলে কেউ আর অবাধে পাখি শিকার করতে পারবে না।
দি বার্ডস সেফটি হাউজের চেয়ারম্যান মামুন বিশ্বাস বলেন, মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল অঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবীরা শিকার করা পাখি অবমুক্ত করলেও তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি সমন্বয়ের অভাবে এ বিলে স্থায়ীভাবে পাখি শিকার বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সিরাজগঞ্জ বন বিভাগের কর্মকর্তা হাসান মাহমুদ জানান, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কার্যকর করার মতো সরকারি জনবল নেই। জনগণ সচেতন না হলে কোনোভাবেই অতিথি পাখি নিধন বন্ধ করা সম্ভব নয়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. ওমর ফারুক বলেন, পাখিসহ বন্যপ্রাণি রক্ষায় যে যার অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের নজরদারি রাখতে হবে। শিকারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে চলনবিলে পাখি নিধন বন্ধ হবে। তা না হলে আগামিতে বন্যপ্রাণির নাম শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে।
তাড়াশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শীত প্রধান দেশ থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসব পরিযায়ী পাখি আমাদের চলনবিলসহ দেশের হাওর-বাওর ও নদী এলাকায় আসে। আমরা শুধু শীতের অতিথি পাখি নয় দেশি প্রজাতিসহ সব ধরনের পাখি শিকার বন্ধে সবসময়ই মনিটরিং করছি। জনসচেতনতা বাড়াচ্ছি। পাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। আশা করছি আগামিতে চলনবিলে পাখির সংখ্যা আরও বাড়বে।