উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত খান উল আজম উলুঘ খান ই জাহানের (খান জাহান) প্রতিষ্ঠিত খলিফাতাবাদ রাজ্যের রাজধানী ছিল বাগেরহাট। ১৫’শ শতাব্দীর প্রাচীন রাজ্য ছিল এটি।
প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর বাগেরহাটের নাম আসলেই প্রথমে মাথায় আসবে বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও খান জাহানের মাজারের কথা। মূল পর্যটন আকর্ষন এ দুই স্পট হলেও এর আশেপাশে ছড়িয়ে আছে আরো বেশ কিছু সমৃদ্ধ দর্শনীয় স্থান। নিজস্ব সংস্কৃতি, চমকপ্রদ খাবার, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও এক শহরের মধ্যেই খান জাহান আমলের নানা ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান থাকায় ভ্রমণ প্রেমীদের কাছে বাগেরহাট অসাধারণ স্থান।
বাগেরহাটে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ১২টি দর্শনীয় স্থান-
১. ষাটগম্বুজ মসজিদ:
ষাট গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য নিদর্শন। বাগেরহাট শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি না থাকায় এর নির্মাণকাল ও নির্মাতার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে নির্মাণশৈলী দেখে ধারণা করা হয় এটি ১৫শ শতাব্দীতে খান জাহানের আমলে তৈরি। এই মসজিদটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি বাংলার সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর একটি চমৎকার নিদর্শন। নাম ষাট গম্বুজ হলেও বাস্তবে মসজিদটির ছাদে ৭৭টি ছোট গম্বুজ এবং কেন্দ্রে চারটি বৃহৎ গম্বুজ সহ মোট ৮১ টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরীণ কাঠামো অত্যন্ত সুদৃঢ়। ৬০টি পাথরের স্তম্ভের উপর এই মসজিদটি স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদের পাশেই রয়েছে ‘ঘোড়া দীঘি’ । জানা যায়, খান জাহান ঘোড়ার পিঠে চড়ে এই দীঘি খননের তদারকি করতেন, সেকারণেই নাম ঘোড়া দীঘি। আবার এমন কথিত রয়েছে যে, একটি ঘোড়ার পিঠে বসে একবার চাবুক মেরেছিলেন খান জাহান। সেই এক চাবুকে ঘোড়া যতদূর দৌড়েছিলো, ততটুকু জায়গায় দীঘি খনন করা হয়। সেকারণেই এই দীঘির নাম হয়েছে ঘোড়া দীঘি। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ষাট গম্বুজ মসজিদকে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
ষাট গম্বুজ মসজিদে প্রবেশের সময় দর্শনার্থীদের নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়। প্রাপ্তবয়স্ক দেশি পর্যটকদের জন্য প্রবেশ মূল্য ৩০ টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য ৫০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহের পর্যটকদের জন্য টিকেট মূল্য ২০০ টাকা। এই একই টিকেটে ষাট গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন জাদুঘর পরিদর্শনের সুযোগ রয়েছে। এ জাদুঘরে বর্তমানে খান জাহান সময়কালীন বহু নিদর্শন রয়েছে।
২. সিংগাইর মসজিদ
সিংগাইর মসজিদটি ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র ২৫ মিটার দক্ষিণ-পূর্বে, খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত। ষাট গম্বুজ মসজিদের ঠিক অপর পাশেই মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটিতে একটি মাত্র গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরীণ কাঠামোও দৃষ্টিনন্দন। এর মেহরাবগুলিও ষাটগম্বুজের মতোই টেরাকোটায় অলংকৃত। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে তিনটি প্রবেশদ্বার এবং পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব রয়েছে। মসজিদটির দেয়ালগুলো প্রায় ২.১০ মিটার পুরু। সিংগাইর মসজিদটির অন্যান্য সাধারণ বৈশিষ্ট্য ষাট গম্বুজ মসজিদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, তবে এর গম্বুজ এবং অলংকৃত মেহরাব অন্যান্য মসজিদ থেকে কিছুটা আলাদা। এই মসজিদে ভ্রমণের জন্য কোন ফি প্রদান করতে হয় না।
৩. বিবি বেগনি মসজিদ
এই মসজিদটি ষাট গম্বুজ মসজিদের পশ্চিমে, ঘোড়া দিঘীর পাড় থেকে সামান্য পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটিও খান জাহান আমলের নির্মিত একটি প্রাচীন মসজিদ। এর চার কোণে রয়েছে চারটি মিনার। মসজিদের গঠনমূলক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে রয়েছে একটি বৃহৎ গোলাকার গম্বুজ। মসজিদটির অভ্যন্তরীণ নির্মাণ শৈলীও আলাদা। কিবলা দেয়ালের ভেতর তিনটি মিহরাব রয়েছে, যার মধ্যে মাঝেরটি অন্য দুটির তুলনায় বড়।
স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, বিবি বেগনি নামে খান জাহানের একজন পত্নী ছিলেন। তার মৃত্যুর পর কবরের উপরে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। মসজিদটি খান জাহান নিজেই নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এই মসজিদটি বর্তমানে একটি জামে মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মসজিদটি সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত।
৪. চুনাখোলা মসজিদ
চুনাখোলা মসজিদটি ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। তবে বিবি বেগনি মসজিদ থেকে পায়ে হেঁটে এখানে যেতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিট। মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট এবং বর্গাকৃতির। চুনাখোলা গ্রামে অবস্থিত হওয়ার কারণে নামকরণ করা হয়েছে চুনাখোলা মসজিদ। মসজিদটি ইটের তৈরি, এবং এর বাইরের প্রতিটি দিকের দৈর্ঘ্য ১২.৫০ মিটার। মসজিদটির দেয়ালগুলি প্রায় ২.১৪ মিটার পুরু, মসজিদটিতে পাঁচটি ধনুকাকৃতির খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে। পূর্ব দিকের তিনটি দরজার মধ্যে একটি কিছুটা বড় এবং অন্য দুটির মতো উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দরজাগুলি সমান প্রশস্ত। মসজিদের অভ্যন্তরে কিবলা দেয়ালের পাশে তিনটি মিহরাব রয়েছে।
চুনাখোলা মসজিদটির ছাদে একটি বিশাল অর্ধগোলাকৃতির গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের বাইরের চার কোণে রয়েছে চারটি গোলাকার মিনার। মসজিদের তিনটি কার্নিশ বাঁকানো আকারে নির্মিত। মসজিদে ব্যবহৃত পোড়ামাটির অলঙ্করণে সাধারণত ফুল, লতাপাতা, জালি ডিজাইন ব্যবহার করা হয়েছে।
৫. খান জাহান নির্মিত প্রাচীন রাস্তা
রাস্তাটির অবস্থান বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাট গম্বুজ ইউনিয়নের মগরা গ্রামে। ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার উত্তর এবং খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে প্রায় ৫০০ মিটার উত্তর দিকে রাস্তাটির অবস্থান। বর্তমানে এই রাস্তার বেশিরভাগ অংশ হারিয়ে গেছে, তবে ইট দ্বারা নির্মিত খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা এবং সেতুসহ প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা এখনও টিকে আছে। এই স্থাপনাও ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত এই রাস্তাটির অস্তিত্ব ছিল। তবে প্রাকৃতিক কারণে এটি বিলিন হয়ে যায়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রাচীন রাস্তাটিকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। রাস্তাটি সম্পর্কে তেমন প্রচার না থাকায় এখানে দর্শনার্থীরা আসেন না বললেই চলে।
৬. খান জাহানের বসতভিটা
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে মাত্র সাড়ে তিনশ মিটার দূরে অবস্থিত খান জাহানের বসতভিটা। খান জাহানের নির্মিত প্রাচীন রাস্তাটিও মূলত এসে এখানেই মিলেছে। এখানে বিশাল একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ এখনো মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে। ধারণা করা হয়, এখানেই ছিলো খান জাহানের বসতবাড়ি। এছাড়া বেশ কিছু ঢিবি আছে এখানে। সেগুলো মূলত এই প্রসাদেরই ধ্বংসাবশেষ। ২০০১ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর প্রথমবার প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করে এই ঢিবিটিতে। এরপর ২০০৮ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মোট ১২টি খননে এখানে প্রাচীন দেয়াল, মেঝে, পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর নালা, পোড়ামাটির তৈরি পাইপসহ নানা স্থাপত্য নিদর্শন পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে রয়েছে প্রদীপদানি, তরবারি, পোড়ামাটির পুঁতি, লাল, কালো ও ধূসর বর্ণের মৃৎপাত্র, প্লেট, গ্লাস, পিরিচ, নল, জালের গুটি, অলংকৃত ইটসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তু। এছাড়া, এখানে পাওয়া স্থাপত্য, মৃৎপাত্র, তৈজসপত্র ও উপকরণের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, তখনকার সময়ে এখানে বসবাসকারীদের রুচিবোধ ছিল অত্যন্ত উন্নত। তাদের নির্মাণশৈলী ও শৈল্পিকতার প্রকাশ মেলে এসব নিদর্শনে। খানজাহানের বসতভিটা এখন বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত।
৭. খান জাহানের সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স
প্রাচীন খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান জাহান (র) এর মাজারটি ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে আড়াই কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত। এই কমপ্লেক্সটি একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। প্রায় সারা বছরই এখানে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। বছরে দুবার সমাধি কমপ্লেক্সে ওরশ ও বার্ষিক মেলা অনুষ্ঠিত হয়। খান জাহানের সমাধির পশ্চিম দিকে তার প্রধান সহচর মুহাম্মদ তাহিরের সমাধি, এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও খান জাহানের অন্যান্য উত্তরসূরীদের সমাধি রয়েছে। কমপ্লেক্সটি ৬৭.১ মিটার পূর্ব-পশ্চিম এবং ৬৪.৭ মিটার উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট বেষ্টনিতে ঘেরা।
খান জাহান আলীর সমাধিসৌধটি বাইরের দিকে ১৩.৭ মিটার এবং ভেতরের দিকে ৯.১ মিটার বিস্তৃত। এটি প্রাচীন ইটের নির্মিত একটি বর্গাকার ভবন, যার চারপাশে চারটি গোলাকার পিলার রয়েছে। খান জাহান আলীর কবরের উপর আরবি ও ফারসি লিপি খোদিত রয়েছে, যদিও অধিকাংশ লেখাই এখন অস্পষ্ট।
কমপ্লেক্সের পাশেই মুহাম্মদ তাহিরের সমাধি, যা তিন স্তরবিশিষ্ট পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ। স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী, তাহির ছিলেন খান জাহানের প্রিয় কর্মকর্তা।
এছাড়া রয়েছে খান জাহানের বার্তাবাহী চারটি পাখির কবর। প্রতি বছর চৈত্র মাসের পূর্ণিমার সময় খান জাহানের মাজারে মেলা ও অগ্রাহায়ন মাসে ওরশ অনুষ্ঠিত হয় এবং লক্ষাধিক লোক তাতে সমবেত হন। এই কমপ্লেক্সে ভ্রমণ করতে কোন প্রকার টিকেট বা অর্থ প্রদান করতে হয় না।
৮. খান জাহান দীঘি
হযরত খান জাহান (রহঃ) এর মাজারের দক্ষিণে রয়েছে প্রায় ২০০ বিঘা আয়তনের একটি বিশাল আকৃতির দীঘি। কথিত এই দীঘিতে হযরত খান জাহান (রহঃ) কালাপাহাড় ও ধলাপাহাড় নামে দুটি বিশাল কুমির ছেড়েছিলেন। তবে এর কোন সঠিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। ওই কুমিরগুলো মারা গেলে পরবর্তীতে কিছু মিঠা পানির কুমির দীঘিতে ছাড়া হয়। মাজার জিয়ারতের জন্য আসা ভক্তরা দীঘির কুমিরগুলোর কাছে হাঁস, মুরগি, ভেড়া, খাসি ইত্যাদি মানত করতেন। কালা পাহাড় মারা যাওয়ার পর তার মমি ষাটগম্বুজ মসজিদের জাদুঘরে রাখা হয়েছে। বর্তমানে দীঘিতে মাত্র একটি কুমির আছে। দীঘির প্রধান ঘাটটি বেশ প্রশস্ত। খান জাহান মাজারে আসা পর্যটকদের অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ হচ্ছে এই দীঘির পাড়ে অবকাশ যাপন। মহিলাদের জন্য আলাদা ঘাটও রয়েছে। দীঘির পানি সুপেয় এবং এটি ঠাকুর দীঘি নামেও পরিচিত।
দীঘির নামকরণের বিষয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তি রয়েছে। একে ঠাকুর দীঘি বলা হয়। কারণ অনেকের মতে, হযরত খান জাহান আলী (রহঃ) স্থানীয় হিন্দুদের কাছে ঠাকুর নামে পরিচিত ছিলেন। আরেকটি মত অনুযায়ী, পীর আলী মোহাম্মদ তাহের খানজাহান (রহঃ) এর প্রিয় বন্ধু ছিলেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাকে খানজাহান (রহঃ) ঠাকুর বলে সম্বোধন করতেন। বর্তমানে দীঘিটিতে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তরে তিনটি বাঁধানো ঘাট রয়েছে। দর্শনার্থীরা এসব স্থানে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
৯. নয়গম্বুজ মসজিদ
খান জাহানের সমাধির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ এবং দিঘির পশ্চিম দিকে নয় গম্বুজ মসজিদ অবস্থিত। এটিও খান জাহান আমলের একটি প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে এখনো টিকে আছে। মসজিদটিতে প্রবেশে কোন টিকেট প্রয়োজন হয় না। মসজিদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্ব বিভাগের অধীনে সংরক্ষিত। ইটের তৈরি বর্গাকার মসজিদটি বাইরের দিকে প্রায় ১৬.৭৬ মিটার এবং ভিতরের দিকে ১২.১৯ মিটার বিস্তৃত। মসজিদের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের প্রাচীর ২.৪৪ মিটার পুরু এবং তিনটি খিলানপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরের কিবলা প্রাচীরে তিনটি মিহরাব রয়েছে, যার মধ্যে মাঝের মিহরাবটি বড় এবং বাইরের দিকে প্রসারিত। মিহরাবের অলংকরণ অত্যন্ত শৈল্পিক, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি ফুলের মোটিফে সাজানো। ছোট মসজিদগুলোর মধ্যে এই মসজিদের টেরাকোটা সবচেয়ে সমৃদ্ধ। এছাড়া পাথরের খিলানে একটি গর্ত রয়েছে। কথিত আছে এটি খান জাহানের হাতের ছাপ।
১০. রেজা খোদা মসজিদ
রেজা খোদা মসজিদটি খান জাহান সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এটি বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত, পশ্চিম দিকের দেয়ালসহ এখনো কিছু অংশ টিকে আছে। মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা করা হয় পূর্ব দিকে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণে দুটি করে খিলানের সাহায্যে প্রবেশদ্বার ছিল। পূর্বের প্রধান প্রবেশপথটি ছিল প্রায় ৪.৭২ মিটার উঁচু। মসজিদটির চারটি কোণে ছিল অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ, যা টেরাকোটায় অলংকৃত ছিল, তবে বর্তমানে সেগুলি ধ্বংস হয়ে গেছে। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি অলঙ্কৃত মিহরাব ছিল, যা এখনো টিকে আছে। কিছুদিন আগে মসজিদটির সংস্কারকাজ চালানো হয়েছিলো।
১১. জিন্দাপীর, পাগল পীর ও ঠাণ্ডা পীরের মাজার
খানজাহান পরবর্তী সময়ে খলিফাতাবাদ রাজ্যে আরো কয়েকজন ধর্মীয় আধ্যাত্মিক পীর ছিলেন। তাদের মধ্যে জিন্দাপীর, ঠাণ্ডাপীর ও পাগলপীর উল্লেখযোগ্য। রেজা খোদা মসজিদের পাশেই জিন্দাপীরের মাজার। এখানে একটি মসজিদও রয়েছে। এছাড়া জিন্দাপীরের কবরসহ তার অনুসারীদেরও কবর রয়েছে। খান জাহান মাজার থেকে ২০০ মিটার উত্তরপূর্বে রয়েছে ঠাণ্ডাপীরের মাজার এবং সেখান থেকে ৩০০ মিটার উত্তরে রয়েছে পাগলা পীরের মাজার। খান জাহানের মতো তাদের মাজারেও ওরশ অনুষ্ঠিত হয়।
১২. রণবিজয়পুর মসজিদ
বাগেরহাট জেলার রণবিজয়পুর গ্রামে অবস্থিত রণবিজয়পুর মসজিদ, যা ফকিরবাড়ি মসজিদ এবং দরিয়া খাঁ মসজিদ নামেও পরিচিত। বাগেরহাট ষাটগম্বুজ পুরাতন সড়কের পাশে অবস্থিত এই মসজিদটি খান জাহান আলীর সময়ে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদের মধ্যে সর্ববৃহৎ মসজিদ এটি।
এর স্থাপত্য শৈলী বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। মসজিদটি ইটের তৈরি। মসজিদের দেওয়ালগুলি অত্যন্ত মোটা (২.৭৪ মিটার)। পশ্চিম পাশের দেয়াল ব্যতীত বাকি তিনটি দেয়ালের প্রতিটিতে তিনটি করে দরজা রয়েছে। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব আছে মাঝের মেহরাবটি অন্য দুটি মেহরাবের তুলনায় বড়। মসজিদের বাইরের কোণায় অবস্থিত মিনারগুলি গোলাকার, তবে মিনারের উপরের অংশে কোন গম্বুজ নেই। মসজিদটির অলঙ্করণ বেশ কিছু অংশে ক্ষয়প্রাপ্ত হলেও এখনও কিছু অলংকরণ দেখা যায়। ১৯৬১ সালে, মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনায় সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এর পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ব্যাপকভাবে এর সংস্কার কাজ চালায়।
কিভাবে যাবেন?
প্রাচীন খলিফাতাবাদ রাজ্যের এতসব সমৃদ্ধ স্থাপনা ও স্থান একদিনের মধ্যেই ঘুরে ফেলা সম্ভব। তবে তার জন্য প্রথমেই আসতে হবে বাগেরহাটে। ঢাকা থেকে ৬৫০ থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যে এসি/নন এসি বাসে চলে আসতে পারেন বাগেরহাটে। নামতে পারেন বারকপুর স্টপেজে। সেখান থেকে ভ্যানে চুনাখোলা মসজিদ ও বিবি বেগনী মসজিদ ঘুরে সোজা চলে যেতে পারেন ষাটগম্বুজ মসজিদে। মাত্র ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যেই সকল পুরাকীর্তি রয়েছে। চাইলে স্থানীয় অটোরিকশায় করে ঘুরতে পারেন বিভিন্ন স্থাপনায়। খরচ হতে পারে জনপ্রতি ৩ থেকে ৪ শ টাকা।
কোথায় থাকবেন?
প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাগেরহাট জেলাটি পর্যটকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এখানে ভালো মানের হোটেল নেই। অধিকাংশ পর্যটকরাই খুলনায় অবস্থান করে একদিনের জন্য বাগেরহাটে আসেন। তবে মোটামুটি মানের বেশ কিছু হোটেল রয়েছে খান জাহান সমাধি কমপ্লেক্স এর নিকটবর্তী খুলনা বাগেরহাট মহাসড়কের পাশে। এসব হোটেলে এসি ও নন এসি রুমে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
কি খাবেন?
বাগেরহাটে খাওয়ার জন্য বেশ কিছু মাঝারি মানের রেসটুরেন্ট আছে। স্থানীয় সেয়াই পিঠা ও হাসের মাংস বাগেরহাটে বিখ্যাত। এছাড়া গরুর মাংস ও চুইঝালের খ্যাতিও রয়েছে দেশজোড়া। একই সাথে চিংড়ির স্বাদ নিতে ভুলবেন না। খান জাহান মাজারের মোড়, এবং ষাটগম্বুজ মসজিদের আশেপাশে বেশ কয়েকটি হোটেল রয়েছে। এসব স্থানীয় খাবার সেসব হোটেল রেস্তোরায় পেয়ে যাবেন।