স্বপ্নজয়ের রাজকন্যা

শাফিকুর রাহী

চিরদুখিনী এক অপরূপ রূপসী জননীর ভাগ্যাকাশে আচমকা গভীর অন্ধকারে নতুন দিনের সূর্য উদিত হলো। যে লোকালয়ে অনন্তকাল ধরে এক জাতিগোষ্ঠীকে নির্মম নিপীড়নের ভেতর দিনাতিপাত করতে বাধ্য করা হয় ভিনদেশি বেনিয়া বর্গি- স্বৈরশাসকগোষ্ঠীর অমানবিক দানবীয় তাণ্ডবে। সে ভয়ানক দুঃশাসনের কবলে পড়ে অব্যক্ত কষ্টের রোদনধ্বনিত হয় আকাশে বাতাসে। এমন দুঃসহ দুর্গতির কালবেলায়ও কারো যেন কিচ্ছু যায় আসে না। সে আর্তমানবতার হাহাকারে আকাশ থমকে দাঁড়ায়; বাতাসও গতি হারায়; সুনীল সমুদ্রের উর্মিমালাও মনকাড়া নৃত্য ভুলে ফরিয়াদ জানায় বিশ্ববিধির মনোমাজারে। এমন এক দুর্বিষহ ভয়ার্তকালে রূপকথার রাজপুত্রকেও হার মানায় এক জনদরদি মানবতার মানসপুত্রের আগমন, প্রকৃতি জানায় বিনম্র শ্রদ্ধা। ভোরের সূর্য বিপ্লবী অভিবাদন জানিয়ে আকাশের সমস্ত কালো মেঘ তাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়।

জগৎখ্যাত সেই রাজার বসতভিটে আলোকিত করে জন্ম নিলেন এক রাজকন্যা। রাজা তখন ভিনদেশী স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগ্রাম করতে গিয়ে কারাগারে বন্দী। সে অবস্থায় রাজাকে তাঁর কন্যাসন্তান জন্মের শুভসংবাদ পৌঁছে দেওয়া হয় অনেক কষ্টে। বন্দি রাজা তো ভীষণ খুশি, আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানান। হে দয়াময় রাব্বুল আলামিন, আপনার মহান রহমতের আলোকধারায় আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর আমার কন্যাসন্তানের উপর আপনার রহমত বর্ষিত হোক।

রাজকন্যা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে শ্যামলিমা বঙ্গজননীর শীতল ছায়াতলে, সকাল বিকাল পাখির গানে বুনো ফুলের মৌ মৌ সুমধুর ঘ্রাণে মন অজানা আনন্দে নেচে ওঠে। এসব অনন্য সুন্দর অরণ্যখচিত পল্লীর নিঝুম লোকালয় আলো আঁধারে মোড়ানো পরিবেশে বেশি দিন থাকা হয়নি রাজকন্যার। রাজা আজ এ কারাগারে তো কাল ওই কারাগারে। ভিনদেশী বর্গিশাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে রাজা মাঝেমধ্যে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে চাইলেই তাঁকে বন্দি করা হয় অন্যায়ভাবে। রাজা তো দমে যাওয়ার মানুষ নন, তিনি এ দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভীষণ ভালোবাসেন। মানুষজনও রাজাকে পরম আপন হিসেবে জানে। গভীরভাবে ভালোবাসে। বিশ্বাস করেন তিনিই কেবল তাদের মুক্তি দিতে পারেন এ জঘন্য দানবীয় দখলদার বাহিনীর দুঃশাসনের কবল থেকে। দুঃসহ-দুর্ভাবনার ভেতর দিয়ে রাজকন্যার বেড়ে ওঠার গল্প শুরু হয়। এক অনন্য সাধারণ সংগ্রামমুখর জীবনের স্বরলিপি রচিত হয় রাজা ও রাজকন্যার পুরো পরিবার জুড়ে। রাজা কারাগারে বন্দি থাকলে কী হবে! রাজকন্যার আম্মাজান খুব ভাগ্যবতী ও আত্মপ্রত্যয়ী ত্যাগী মহীয়সী নারী। রাজকন্যাকে অতি আদরযত্নে লালন পালন করেন এবং তার আব্বাজানের শূন্যতা বুঝতে দেন না কখনো।

রাজকন্যার নাম রাখেন- হচুমণি, একদিন কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে সরাসরি নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলেন রাজা। তাঁর মনে আনন্দ আর ধরে না, এতো খুশি হয় হাচুমণিকে দেখে। আদর করে আর বলতে থাকে তুমি বুঝি আমার এ আঁধার ঘেরা মাতৃভূমিকে পূর্ণিমার শুভ শুভ্র আলোয় ঘোর অন্ধকারকে তাড়িয়ে দেবে মা! রাজার আদরের কন্যা একদিন বিশ্বজয় করবে এটা কি তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন! যে কন্যা তাঁর শতবাধার আঁধার ভাঙতে গিয়ে বারবার মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করেছেন! আর শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে উড়িয়েছেন সাফল্যের উদয় কেতন। রাজকন্যার অমন অবিস্মরণীয় বিজয়গাথায় চমকিত হয় বিশ্ববিবেক; প্রশংসায় পঞ্চমুখ তাবৎ গৃহলোক। এমন আনন্দঘন দিনে রাজকন্যা ভাবেন তাঁর পরম আপনজনের মায়া-মমতার সোহাগি পরশের হৃদয় আকুল করা ভালোবাসার স্পর্শগাথা। এ শ্যামলিমা মাতৃভূমি যখন শত্রুমুক্ত হলো অসংখ্য প্রাণের আত্মদানে রাজার দীর্ঘ আত্মত্যাগের গৌরবগাথায়, সে মুক্ত আলো-বাতাসে বিজয়ের মহিমায় আনন্দ আবেগে আত্মহারা প্রকৃতিও খুশিরবানে হেসে ওঠে। চারদিক কী এক মমতার চাদরে মোড়ানো স্বদেশের মাটিতে নৃত্যে মাতাল সোনালি পায়রা। তেরোশত নদী আর সমুদ্রের ঊর্মিমালা স্বাগত জানায় প্রাণপ্রিয় রাজার গৌরবোজ্জ্বল বিজয়গাথায়।

কতো না সন্তানহারা মায়ের মলিন অবয়বে ফুটে ওঠে কান্না ভোলার গান। কতো স্বামীহারা বোনের বুকভাঙা মাতমের কালে পূর্বদিগন্তে অরুণ প্রভা জানান দেয় কষ্ট ভোলার রোদঝলসিত ভালোবাসার। সে রক্তেভেজা-স্বপ্নেমোড়ানো স্বদেশের মানচিত্র আনন্দ উল্লাসে, বাধভাঙা জোয়ারে ভাসমান। ঠিক তখনই এক অশুভ অপয়া ডাইনী হানে মারণঘাতি আঘাত। সে বিশ্বাসঘাতক মানুষ নামের কলঙ্ক- বিজয়ী বীর রাজার বিশাল উদার আকাশবুকে ছোঁড়ে গুলি। সেদিন থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার অভিশাপের অনলে হয় দগ্ধ তাবৎ গৃহলোক। সে লোকালয়ের পাখিরা গান ভুলে যায়, বাগানে ফোটে না ফুল, প্রকৃতি আকাশফাটা বিলাপের আয়োজন করে। ডুবে গেলো শতজনমের শত সহস্র আরাধনায় প্রস্ফুটিত গোলাপ। সে প্রাণপ্রিয় স্বজন হারানোর শোকার্ত রোদনে আচমকা কেঁপে ওঠে মানচিত্র। কেঁপে ওঠে তৃতীয় আকাশ। কৃষক-শ্রমিক, মাল্লা-মাঝি শোকসংগীতে হলো দিশেহারা। তামাম জমিন ও আসমান জুড়ে বেদনার বিউগল বাজে। সমগ্র জাতি হলো শোকাগুনে স্তম্ভিত, পাথরপ্রায় রাজার বিয়োগ ব্যথায়। সে দুঃসহ দুর্গতির কারবালাকালে রাজকন্যা ভিনদেশে বেড়াতে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান। আর সে রাজ্যে নেমে আসে ভয়ার্ত অন্ধকার এক।
সে দেশের রাজাহীন প্রজাদের কেউ আর ভালো চোখে দেখে না। তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হলো। ভয়ঙ্কর এক সামরিক হস্তারকের হিংস্র তাণ্ডবে গতিহারা প্রগতির সকল যাত্রাপথ। এমন এক দুর্বিষহ নিদানের কারবালাকালে ভিন দেশের অন্ধকার প্রকোষ্ঠের বাধার আঁধার ভেঙে দীর্ঘ পরবাস থেকে রাজার রেখে যাওয়া স্বদেশে ফেরার দুঃসাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেন রাজকন্যা। তাঁর এ জগৎ সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। তিনি নিজেকে মাঝেমধ্যে বড় একা ভাবেন; পরক্ষণেই মনাকাশে ভেসে ওঠে লক্ষ জনতার আবেগীয় শব্দকলায় উচ্চারিত ‘হাসু আপুর ভয় নেই, আমরা আছি তোমার সাথে। এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে, হাসু আপুর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, মুজিব হত্যার পরিণাম বাংলা হবে ভিয়েতনাম’।

রাজকন্যা ভাবতে শুরু করলেন তিনি একা নন, তার পাশে রয়েছে লক্ষ কোটি মুজিবপ্রেমী মানুষ। তিনি আপনহারা নন; দেশের সকল মানুষ তাঁর আপন। এমনটি ভাবতে ভাবতে রাত কেটে যায়; পূর্ব দিগন্তে সোনালি সূর্য স্বাগত জানায় রাজকন্যাকে। তিনি সাহসের উল্কা হয়ে জগৎবাসীকে দেখিয়ে দিতে চান প্রবল প্রতাপের সঙ্গে তাঁর সক্ষমতা। আর এ সংকল্পে বলিয়ান হয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন পিতার অমীমাংসিত স্বপ্নসাধনা তিনি বাস্তবায়ন করবেন। মানুষের অসাধ্য বলতে কিছু নেই, যদি সে সততা আর ন্যায়ের পথে তার অভিযান শুরু করতে পারেন তাহলে জয় অনিবার্য সত্য। মানবতার মুক্তির লড়াই করতে গিয়ে রাজকন্যাকে অনেক বাধার সম্মুখিন হতে হয়। তিনি ওসব কিছুকে পরোয়া করেন না। কারণ তাঁর সঙ্গে রয়েছে কোটি মানুষের ভালোবাসা বিশ্বাস- পিতার মহান আদর্শ; তিনি আদর্শকে মনের গভীরে লালন করেন অতি যত্নে। তাকে বারবার হত্যার সম্মুখিন হতে হয়েছে তাতেও তিনি কখনো সাহস হারাননি। কারণ তিনি দমে যাবার মানুষ নন। তিনি মনে করেন তাঁর উদ্দেশ্য মাটি ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে সমর্পণ করা। এতে মৃত্যু হলে হবে; তাতে তাঁর কোনো আফসোস নেই। কারণ মানুষ জন্মিলে তার মৃত্যু অনিবার্য। তাহলে আর মৃত্যুকে কেন ভয় করবো! ভয় যদি করতে হয় করবো মহান সৃষ্টিকর্তাকে।

তাছাড়া মানবতার শত্রুদেরকে ভয়ের প্রশ্নই ওঠে না: রাজকন্যার আদর্শিক প্রভায় জেগে ওঠে অধিকার বঞ্চিত দুখি মানুষ। রাজকন্যার সঙ্গে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় লাখো জনতা। তারা সকলেই ফিরে পেতে চায় জগৎকাঁপানো রাজার হারানো গৌরব। আর তাদের সে গৌরবের সঙ্গে মিশে আছে লাখো মুক্তিকামী বীরসন্তানের আত্মদানের গর্বিত ইতিহাস। সে আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস কী কখনো ভোলা যায়? যে দেশের শ্যামল শস্যভূমি লাখো শহীদের রক্তেভেজা! সে দেশের সাধারণ সচেতন নাগরিক সমাজ কখনো কী এমন গৌরবের দীপ্তশিখা অস্বীকার করতে পারে? এমনসব ভাবনা থেকে জেগে ওঠে সাধারণ মানুষ বীরদীপ্ত শপথে বলিয়ান হয়ে রাজকন্যার কন্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে। সত্যকে যারা অস্বীকার করে তারা কখনো স্বাভাবিক মানুষের কাতারে পড়ে না। সে কারণেই সততা আর সত্যের মশাল হাতে বীর বিপ্লবীবেশে দৃঢ় প্রত্যয়ে হাতে হাত রেখে মানবতার মুক্তির স্বপ্নসাধনায় এগিয়ে চলেন প্রাণের সকল আপনহারা- রাজকন্যা। যার জীবন শুরু হয়েছিল মায়ামমতার অফুরন্ত ভালোবাসার মায়াবী আঁচলে মোড়া। যিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাঁর পিতা মাটি ও মানুষের প্রেমে কিভাবে দুঃসহ সংগ্রাম করতে গিয়ে বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কতোবার ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতে হয়েছে সে বিপ্লবী রাজাকে।

রাজকন্যা রাজনীতির প্রথম পাঠশালায় হয়তো এমনটি কখনো ভাবেননি যে তাঁকে তার পিতার রেখে যাওয়া সংগঠনটির দীর্ঘ চার দশকেরও অধিক সময় ধরে এর সভাপতির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করাও এর সঠিক নেতৃত্ব দিতে হবে তাঁকে। অথচ তিনি ঘরের শত্রু বাইরের শত্রুদের সকল ষড়যন্ত্রকে সামাল দিয়ে তা পালন করার সক্ষমতা অর্জনেও সফল। তাঁর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস আর অত্যন্ত সাহসী ও মানবিক-আদর্শবান রীতিনীতির মানুষ হিসেবে নিজেকে আবিষ্কারের অনন্ত সাধনায় যিনি পথ হাঁটেন পথের সন্ধানে। সে রাজকন্যার শুভবাদের গতিপথ রোধ করার শত ষড়যন্ত্রের অশুভ চক্রান্তকারীগোষ্ঠী আজো তাঁদের অপযুদ্ধের ঘৃণিত রণকৌশল অব্যাহত রেখেছে। আর এসব দেশদ্রোহী মানবতার দুশমনদের এ পবিত্র মাতৃভূমি থেকে সমূলে উৎখাতের বিউগল বাজাতে হবে সচেতন নাগরিক সমাজ ও বীরতারুণ্যকে। যে শ্যামল কোমল রমণীয় মানচিত্র লাখো বীর শহীদের রক্তেভেজা মানবীয় অরণ্য উদ্যানে কোনো গুপ্তঘাতক জঙ্গী-সন্ত্রাসীর নষ্ট আস্ফালনে ফের রক্তাক্ত হবে সেটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে লক্ষ্যে রাজকন্যা দীর্ঘদিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন দেশীয় আন্তর্জাতিকভাবে সেটি মোকাবেলা করার। রাজকন্যার সবসময় একই ভাবনা, রাজার রেখে যাওয়া অসমাপ্ত সকল ইস্যুকে সফল সমাধানের ভেতর দিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চান মানবসভ্যতা বিকাশের আলোকধারায় ন্যায়-নীতি ও সুশাসনের মধ্যদিয়ে।

এমন সব ভাবনা এসে তাঁর মনের অলিন্দে ঘুরপাক খায়; তিনি গূঢ় গভীরভাবে মানবতার আমূল মুক্তির মিছিলে নিজেকে সমর্পন করেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ভেতর দিয়ে। মানুষের এ ক্ষণপরবাসে জীবন-জীবিকার দুঃসাধ্য সাধনের মাঝে লক্ষ্য করা যায় সত্য-আর মিথ্যার লড়াইয়ে কেউ হারে কেউ জিতে। এর ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যায় অমূল্য সময়। রাজকন্যা মাঝেমধ্যে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেন স্বজনহারানো বিপুল জনগোষ্ঠীর বুকভাঙা আহাজারিতে কম্পমান লক্ষ প্রাণের আত্মদানে অর্জিত প্রিয় মাতৃভূমি। তাঁর আব্বা-আম্মাকে অনেক সময় তন্দ্রাহারা অন্ধকারে আচমকা জ্যোৎস্নার প্লাবনে চন্দ্রিমা প্রভায় ভাসতে দেখে আনন্দ অশ্রুতে যেন শ্রাবণের বারিধারা বয় দু’চোখের জমিনে তাঁর। তিনি তাঁর অতীত ইতিহাসের মনোভাবনায় নিমগ্ন তপস্যায় মহান রাব্বুল আলামীন সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য প্রকাশে তসবিহ হাতে ধ্যানরত সময় কাটান নিরলসভাবে। তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে তিনি কখনো বিন্দুমাত্র সময় অপচয় করেন না, তাছাড়া মানবতার মুক্তির আরাধ্য সাধনায় রাজার সে হারানো পথকে অনুসরণ করেন। তিনি দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন মাটি ও মানুষের ব্যাপক উন্নয়নের অগ্র-অভিযানে বীরদাপটে বিপুল সম্ভবনার দ্বার উন্মোচন করেন।

গণমানুষের কল্যাণ সাধনে তিনি বদ্ধ পরিকর, প্রতিটি মানুষ উন্নত জীবনের অধিকারী হবে আর সত্য ও সুন্দরের স্বপ্নসাধনায় হবে উজ্জীবিত, বিনয়ী মানবিক এবং সচেতন। যাদের মাঝে কখনো বিবাদ বিভাজনের সৃষ্টি হবে না। যা চির উজ্জ্বল মৃত্যুঞ্জয়ী রাজার দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন, তিনি সবসময় এমনটিই মনে করতেন বলে প্রতীয়মান হয়। এমনসব নানা উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে রাজকন্যা প্রত্যক্ষ করলেন তার পিতাকে যারা হত্যার ষড়যন্ত্র পাকিয়েছিলো; তারাই আবার তাকে হত্যার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এসব অশুভ দানবীয়গোষ্ঠীকে কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে লক্ষ্যে তিনি দুঃসাহসী ভূমিকা গ্রহণ করলেন। স্বাধীনতা বিরোধী দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেখিয়ে দিলেন- সত্যের জয় হয়। তাঁর এ দুঃসাহসী সংগ্রামমুখর বিপ্লবী উত্থানের মহিমান্বিত গৌরবগাথা লিখে কখনো শেষ করা যায় না। তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তবে ইতিহাসের গূঢ় গভীর ভাবনায় জ্যোতির্ময় প্রভায় কোনো একদিন হয়তো সত্য অনুসন্ধানকারী কোনো ঐতিহাসিকবিদ জ্ঞানীর কলমের কালিতে লেখা হবে আমাদের পূর্বপুরুষের অমূল্য আত্মত্যাগের সেসব মর্মস্পর্শী অবিস্মরণীয় কালের ইতিহাস।

আর ওইসব বিশ্বাসঘাতকদের নির্মমসব হত্যাকাণ্ডেরও বর্ণনায়িত হবে আগত বিদগ্ধজনের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ ঘটনাবলী প্রকাশের মধ্যদিয়ে। রাজকন্যার প্রগতিশীল নেতৃত্বের ক্যারিশমাটিক কর্মকাণ্ড রাজার দীর্ঘকালের লালিত স্বপ্নের সফল বাস্তবায়ন হতে চলেছে। দেশের জনগণ রাজকন্যার পরম আপন, তাদের সুখে-দুঃখে আপদে-বিপদে তিনি হাত বাড়িয়ে দেন আপন মহিমায়, উদার দৃষ্টিভঙ্গির প্রবল প্রখরতায়। তিনি মানবিকতার বিরল ইতিহাস রচনা করেছেন যা ইতোমধ্যে তাবৎ জগৎবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। তাঁর বিচক্ষণতা ও দীপ্ত প্রজ্ঞার দারুণ প্রভায় কিভাবে বসতভিটেহারা অসহায় মানুষ আনন্দে নেচে ওঠে। তিনি আশাজাগানিয়া শব্দসম্ভাষণে উচ্চারণ করেন কোনো মানুষ আর গৃহহারা থাকবে না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের সকলের বাড়িঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। এরই মাঝে সে কর্মসূচি প্রণয়ের আলোকোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নানাবিধ কর্মযজ্ঞের ভেতর দিয়ে মানুষের ভাগ্যউন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে বিধায় দেশের মানুষের আজ সুখেশান্তিতে বসবাসের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজকন্যার স্বপ্ন প্রাণসংহারি মারণাস্ত্রমুক্ত বিশ্ববিনির্মাণের নানা গর্বিত কর্মপরিকল্পনা। তিনি যুদ্ধবাজ পরাশক্তি দেশ গুলোর প্রতি ও বিশ্ববাসীকে আহ্বান করেন, যুদ্ধ কখনো কোনো সমাধান দিতে পারে না।

সে কারণেই অস্ত্রবাণিজ্যের পথ পরিহার করে আমরা সকলে মানবতার জয়গান গাইবো আনন্দ উল্লাসে সৌহার্দ্য সম্প্রীতির মহাবন্ধনে। আমাদের মূল লক্ষই হবে গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি তাদের জীবনমান উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা, যাতে করে সাধারণ মানুষ তার নিজের উপর আত্মবিশ্বাস স্থাপনে সমর্থ হয়। এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আমূল পরিবর্তন না হলে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো কখনো সম্ভব নয়। সে লক্ষ্যে রাজকন্যা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন অস্ত্রমুক্ত বসতি স্থাপনে- আর মানবতার মহামুক্তির স্বপ্নসাধনায়। যে মানবসভ্যতার বিকাশমানধারায় কোনো বিবাদ বিভাজন থাকবে না, থাকবে না অহেতুক প্রাণবিনাশী অস্ত্রের দানবীয় হুংকার, বেহুদা বাহানায় মানুষ কখনো অপরের ক্ষতিসাধনের চিন্তাও করবে না। সে স্বপ্ন নিয়ে রাজকন্যা দেশবিদেশে সেমিনারে-সিম্পোজিয়ামে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে এর কর্মপরিধি সম্পর্কে ব্যাপকভাবে বিস্তারিত রূপরেখা প্রণয়নের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। জনমানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন না ঘটাতে পারলে এ সমাজ থেকে দুর্নীতি দুর্বৃত্তায়ন নির্মূল করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। তারই ধারাবাহিকতায় রাজকন্যা ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্রমুক্ত দেশ গড়ায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। সে লক্ষ্যে তিনি দীর্ঘদিন ধরে আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

এখানে সকল দল মতের অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে জোরালো ভূমিকাও তিনি নিয়েছেন একজন মানবদরদী নেতার বিরল ব্যক্তিত্বের উদার নীতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রাজকন্যা ভাবেন তাঁর অতীতের দুর্বিষহ মনোকষ্টের ভয়ার্ত কাল এবং আলোকোজ্জ্বল ইতিহাসের গর্বিত অধ্যায় সূচনার দুঃসাহসী সংগ্রামমুখর দিনের কথা। কিভাবে ঝড়ক্ষুব্ধ দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সংকল্পে রাজার মহান আদর্শে প্রাণিত হয়ে বাঙালির হারানো ইতিহাস ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও শিক্ষা সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ ধারাকে বিশ্বমানে উন্নতি সাধনের প্রতিজ্ঞা কররেন। তাঁর সে সংগ্রাম আজো অব্যাহত রয়েছে, দেশের গরিব-দুখি মেহনতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ সমগ্র দেশজুড়ে দৃশ্যমান। এসব বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হলে বাংলাদেশের রূপপাল্টে যাবে। আর বিজয়ী জাতির কণ্ঠে উচ্চারিত হবে ‘মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তপ্রিয় শান্ত ছেলে, তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি, তোমার ভয় নেই মা- আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। রাজকন্যা তাঁর জীবন সংগ্রামের আলোকে প্রগতিশীল ভাবধারায় মানবতার কল্যাণে সুদূর প্রসারি কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল হারানো অধ্যায়কে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আলোকিত আগামী বিনির্মাণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে করেছেন বিস্মিত।

তারই আলোকে তিনি ক্রমাগত নতুন উজ্জীবনী শক্তির উন্মেষ ঘটিয়ে সকল স্তরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকরূপে উদ্ভাসিত আজ। এখানেই তাঁর সফলতার অসামান্য কৃতিত্ব। তিনি কালের আয়নায় অবলোকন করেন কী করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আলোকিত আবাসভূমি-পুষ্পিত উদ্যান গড়ার দারুণ বিভায় বিভোর রাজকন্যা। তিনি সুবর্ণ সকালের স্বপ্নবীজ বপন করে আশাহত মানুষের জেগে ওঠার শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়ে এক বিরল ইতিহার রচনা করেছেন যা ইতোমধ্যে তাঁর সে দার্শনিক আদর্শ বহির্বিশ্বেও ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। রাজকন্যা মানবতার মুক্তির মিছিলে সে ছাত্ররাজনীতির ময়দানেও অংশগ্রহণের ভেতর দিয়ে নিজেকে জানান দিয়েছেন মাটি ও মানুষের দুশমনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধে। তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করলেন তাঁর পিতার বিশ্বকাঁপানো বিপ্লবী কন্ঠস্বরে কিভাবে অধিকার বঞ্চিত কৃষক শ্রমিক ছাত্র- বীরতারুণ্য বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দখলদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে।

তাঁর রাজনীতির শুরুটা হয়েছিলো পঁচাত্তর পরবর্তী দেশে ফেরার মাধ্যমে ভয়ানক এক সামরিক হন্তারকের দুঃশাসনের অন্ধকার যুগে। তিনি সে ভয়ঙ্কর অন্ধকার ভাঙার দীপ্ত মশাল জ্বালাবেন বলে জাতির কাছে জবান দিয়েছিলেন। সে লক্ষ্যেই জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে রাজার প্রিয় মানুষজনকে জাগ্রত ও সচেতন করলেন তুমুল উদ্ধারের অদ্ভুত দুঃসাহসী উদ্যোগের মধ্যদিয়ে। সেসব এখন ইতিহাসের আলোকধারায় বিকশিত হচ্ছে ধাবমান গতি ও প্রগতির সুরেলা সাম্পানে- তাঁর স্বপ্নসারথি রাজকন্যা। তিনি আজ সাফল্যের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করেছেন দেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও আন্তরিকতার নজিরবিহীন ইতিহাস রচনার ধারাবাহিক উত্থানের ফলে। তিনি ভাবেন বাঙালি জাতির উত্থান-পতনের দুঃসহ দুর্গতির ভয়াবহ কালবেলা কিভাবে অতিক্রম করেছেন রাজার আদর্শিক চিন্তা-চেতনার মূল উৎসের সোপান বিনির্মাণের। যে মানবতল্লাটে ইতিহাস বিকৃতির ভয়ঙ্কর অন্ধকার যুগের সে ভয়াবহতা কে না জানে! রাজকন্যা সে রাজনীতির শূন্যতা ও ভয়ানক পতন-অবক্ষয়ের নিদারুণ নিদানের কালবেলায় পরম মমতায় ভালোবাসার অফুরন্ত গোলাপ ফোটানো অঙ্গীকার করলেন রাজার প্রিয় বাংলা ও বাঙালিকে উদ্ধারের দৃঢ় প্রত্যয়ে।

বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের যে উজ্জ্বল অতীত ইতিহাস রয়েছে তা দুনিয়ার খুব কম দেশের আছে বলে প্রতীয়মান হয়। রাজকন্যা আজ বিশ্বরাজনীতির গুরত্বপূর্ণ প্রাজ্ঞ অংশিদার। বিশ্বের দেশে দেশে তাঁর শুভাকাক্সিক্ষর সংখ্যাও দ্রæত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া জ্ঞানীগুণি বিদগ্ধ বিবেকবান মানুষজনও তাঁর আদর্শিক আভায় প্রজ্বলিত। রাজকন্যা তাঁর পিতার অমূল্য অবদানকে গভীর ভালোবাসায় ও বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তুললেন সাধারণ মানুষের মনোলোক। তাঁর জনকল্যাণমুখী কর্মপ্রয়াসের ভেতর লক্ষ্য করা যায় মাটি ও মানুষকে কতোটা ভালোবাসলে এ দুঃসাধ্যকে সাধনে ব্যাপক সফলতা অর্জন করা সম্ভব। সেটি তাঁর দীর্ঘ রাজনীতির মাঠে কিংবা বহির্বিশ্বের সঙ্গে কূটনীতির জটিল ও কঠিন অমীমাংসিত ইস্যুকে সফল সমাধানের গতিপথ ত্বরান্বিত করেন আপন আলোয়। তাঁকে অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা জানানোর সে প্রাজ্ঞ জ্ঞানবোধ আজো সঞ্চয় হয়নি এ ক্ষুদ্রপ্রাণ মুজিবপ্রেমীর ক্ষয়ীষ্ণু মনোমস্তিষ্কে। রাজকন্যা- আপনার শুভবাদের আলোকিত পথচলা আরো দীর্ঘ হোক। আপনার কর্মময় জীবন সফল ও সার্থক হোক। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটুক সুখ-আনন্দে। আর বিপজ্জনক বৈষম্যের থাবা থেকে মুক্তি পাক রাজার দীর্ঘকালের স্বপ্নসাধনার প্রিয় মাটি ও মানুষ। সমঅধিকারের জ্যোতির্ময় বীভায় হেসে উঠুক তাবৎ গৃহলোক। জয় হোক সকল শ্রেণিপেশার মেহনতি মানুষের। জয়তু রাজকন্যা, আপনার দীর্ঘ সুস্থ জীবনের প্রত্যাশায়।

লেখক : কবি. সাহিত্যিক. ক্ষুদ্রপ্রাণ মুজিবপ্রেমী।

Print Friendly

Related Posts