মাওলানা নোমান বিল্লাহ
কোরবানি আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী পৌঁছার অন্যতম একটি আমল। নির্দিষ্ট দিনসমূহে কোরবানি করার সামর্থ্য যার থাকবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা খরচ করে যদি কোরবানি আদায় না হয় তাহলে তা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনে কোনো কাজে আসবে না।
কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য বেশকিছু বিষয় লক্ষ রাখতে হয়। নিম্নে সেসব বিষয় তুলে ধরা হলো।
নিয়ত বিশুদ্ধ না হওয়া
কোরবানি আল্লাহ তাআলার কাছে কবুল হওয়ার জন্য একনিষ্ঠ নিয়ত জরুরি। কোরবানি হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য। অন্য কারো সন্তুষ্টি অথবা লোক-দেখানো উদ্দেশ্য অথবা কম টাকায় অধিক গোশত বা ভালো গোশত পাওয়া যাবে, এ ধরনের নিয়তে কোরবানি করলে ওই কোরবানি শুদ্ধ হবে না; কবুলও হবে না। তবে কোরবানি শেষে গোশত খাবো, এ ধরনের কামনা অন্তরে বিরাজ করলে কোরবানি অশুদ্ধ হবে না। (সুরা হজ ৩৭, মুসনাদে আহমদ ২২৯৮৪)
হারাম টাকায় কোরবানি করা
সম্পূর্ণ হালাল সম্পদ থেকে কোরবানি করতে হবে। হারাম টাকায় কোরবানি করলে ওই কোরবানি শুদ্ধ হবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা পবিত্র, তিনি পবিত্র ও হালাল বস্তু ছাড়া গ্রহণ করেন না।’ (মুসলিম ১০১৫)
পশুর বয়স শরিয়ত নির্ধারিত বয়সের কম হওয়া
তিন ধরনের পশু দিয়ে কোরবানি করা যায়। যথা, ১. ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। ২. গরু, মহিষ। ৩. উট। তাদের আবার নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে। এর কমে কোরবানি শুদ্ধ হয় না।
উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। গরু ও মহিষের বয়স দুই বছর হতে হবে। ছাগলের বয়স এক বছর হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বার বয়সও এক বছর তবে সংকটের সময় ৬ মাসের হলে সমস্যা নেই। (মুসলিম ১৯৬৩)
ত্রুটিপূর্ণ পশু কোরবানি করা
কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য পশু হতে হবে বড় ধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু দিয়ে কোরবানি হবে না। অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট; রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট; পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত, যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ ( ইবনে মাজাহ: ৩১৪৪)
জবাইয়ের সময় বিসমিল্লাহ না বলা
কোরবানির পশু জবাইয়ের সময় ইচ্ছাকৃত বিসমিল্লাহ না বললে কোরবানি হবে না। কিন্তু যদি ভুলে বিসমিল্লাহ না বলে, তাহলে কোরবানি হয়ে যাবে। (সুরা আনআম ১২১)
পশুর গলার অন্তত তিন রগ না কাটা
জবাই করার সময় চারটি রগ কাটা জরুরি। যথা- ১. কণ্ঠনালি, ২. খাদ্যনালি, ৩. দুই পাশের মোটা রগ, যাকে ওয়াজদান বলা হয়। এই চারটি রগের মধ্যে যেকোনো তিনটি কাটা হলে কোরবানি শুদ্ধ হবে। যদি দুটি বা একটি কাটা হয়, কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (হেদায়া: ৪/৪৩৭)
শরিকের সংখ্যা নির্ধারণ অশুদ্ধ হওয়া
একটি উট অথবা গরু-মহিষে সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে। (মুসলিম: ১৩১৮) ইমাম শাওকানি (রহ) বলেন, ‘হজের কোরবানিতে দশ এবং সাধারণ কোরবানিতে সাত ব্যক্তি শরিক হওয়াটাই সঠিক। (নাইলুল আওতার: ৮/১২৬) কিন্তু মেষ বা ছাগলে ভাগাভাগি বৈধ নয়। আবার বড় পশুতে সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগেও কোরবানি জায়েজ। কিন্তু সাতের অধিক লোকের শরিকে কোরবানি শুদ্ধ নয়। (মুসলিম: ১৩১৮; বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭)
শরিকের কোরবানির অর্থ হারাম হওয়া
জেনেশুনে হারাম উপার্জনকারীকে কোরবানির অংশীদার করলে অন্য শরিকদের কোরবানিও সহিহ হবে না। (সুরা বাকারা ৪২, মুসলিম ১০১৫) তবে, বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি হবে, শুধু হারাম টাকার অংশীদারের কোরবানি হবে না। (সুরা বাকারা: ২৮৬)
শরিকের নিয়ত অশুদ্ধ হওয়া
ইসলামি শরিয়তের বিধান হলো- শরিকের মধ্যে শুধু একজনের নিয়তে গন্ডগোল থাকলে কারো কোরবানিই শুদ্ধ হবে না। এ বিষয়ে ফতোয়ার কিতাবগুলোতে বলা হয়েছে, যদি কেউ আল্লাহ তাআলার হুকুম পালনের উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে কোরবানি করে, তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারো কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে শরিক নির্বাচন করতে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯)
এক্ষেত্রে নিয়ত অশুদ্ধের বিষয়টি অন্য শরিকদের অজানা থাকলে তাদের কোরবানি হবে, শুধু তার কোরবানি হবে না। (সুরা বাকারা ২৮৬)
ভাগ-বণ্টনে গরমিল করা
কোরবানির পশুতে প্রত্যেক অংশীদারের অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ অন্যের অংশ থেকে কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানি শুদ্ধ হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭)
প্রসঙ্গত, অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। পা ও মাথার ক্ষেত্রেও একই বিধান। তবে কেউ যদি নিজের ভাগের অংশ অন্যজনকে দিয়ে দেয়, তাতে সমস্যা নেই (আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩১৭)