তারেকুর রহমান : রোহিঙ্গা সংকটের ৭ বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বিপদে পড়া মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিলো বাংলাদেশ। তারপর থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে রয়েছে।
এ সাত বছরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার কয়েক দফা বৈঠক বসলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি এখনো পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসন হয়নি।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে আসার পর থেকেই কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। এরপর তাদের বাসস্থান তৈরি করতে ধ্বংস হয় শত শত একর বনাঞ্চল ও পাহাড়। এদিকে ক্যাম্পগুলোতে হু হু করে বাড়ছে জন্মহার। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, খুন-খারাবি ও অস্ত্র-মাদক বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয়দের গলার কাটায় পরিণত হয়েছে উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা।
ক্যাম্পে বাল্য বিয়ে ও অধিক জন্মহার:
বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই মনে করেন মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে না দিলে এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ করলে পাপ। বাল্য বিয়ে ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তারা সচেতন নয়। তাই মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। আর বিয়ের উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই ১/২ সন্তানের মা হচ্ছেন মেয়েরা। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকেই মেয়েদের পাত্রস্থ করলে সহিংসতা ও যৌন নিপিড়ন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় বলে মনে করেন ক্যাম্প-৮/ডব্লিউ, এ ব্লকের বাসিন্দা মিনারা বেগম।
মিনারা মনে করেন, মেয়েরা প্রথম পিরিয়ড হওয়ার পর পরই বিয়ে দিয়ে দিলে ভালো। কারণ ক্যাম্পে কোনো বাড়িতে অবিবাহিত নারী থাকলেই সহিংসতা ও যৌন হয়রানি বেড়ে যায়। সবসময় আতংকে থাকতে হয় অভিভাবককে। নারীর গর্ভধারণ ক্ষমতা, প্রজনন স্বাস্থ্য, নবজাতকের মৃত্যু, মা ও শিশুর পুষ্টিহীনতাসহ কোন ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়েই খুব ভালো জানাশোনা নেই মিনারা বেগমের।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন ৯০টির বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের চাহিদা। ফলে উর্ধ্বমুখী জন্মহার এদেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বাল্য বিয়ে ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সচেতন করতে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৩৫টি এনজিও’র সাড়ে ৩ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করছে। এরফলে এখন অনেকই জন্মনিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হচ্ছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পার্টনার্স ইন হেলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (পিএইচডি) জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক ডা. মো. দানিয়েল হোসাইন বলেন, ‘সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাজনিত সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেশি। বাল্য বিয়ের ফলে জন্মহারটাও বাড়ে। বাবা-মায়েরা চিন্তা করেন, তাদের মেয়েটা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে পারলেই মেয়েটা নিরাপদে থাকবে। এই প্রথার সঙ্গে তারা অভ্যস্ত। কিন্তু বাল্য বিয়ের বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কম। তবে বাল্য বিয়ের ঝুঁকি ও জন্মনিয়ন্ত্রণে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে সচেতনতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি নেতা, ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে নিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে বাল্য বিয়ে ও অধিক জন্মহারের প্রথা অনেকটা কমিয়ে এসেছে।’
হুমকির মুখে স্থানীয়রা, বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা :
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয়রাও। রোহিঙ্গারা তাদের জন্য আতংক হয়ে উঠেছে বলে জানায় তারা। রোহিঙ্গাদের অপকর্ম দিন দিন বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে উখিয়ায় ও টেকনাফ দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ চাহিদার তুলনায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ কম। এছাড়াও রোহিঙ্গাদের বাসস্থানের জায়গা দিতে গিয়ে জমি কমে যাওয়ায় উৎপাদনতো কমেছেই, চাহিদা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ বেশি। ফলে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রত্যাবাসন নিয়ে যা বলছে রোহিঙ্গারা :
কক্সবাজারের উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা ১৬ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি মোহাম্মদ সৈয়দ বলেন, দীর্ঘ সাত বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি। অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছি। তবুও নিজের জন্মভূমিকে ভুলতে পারি না। জন্মস্থান মিয়ানমারে না খেয়ে থাকলেও নিজের দেশ বলে স্বাধীন স্বাধীন লাগে। আমাদের দাবিগুলো মেনে নিলে আমরা স্বেচ্ছায় মিয়ানমারে ফিরে যাবো।
থাইংখালী ১৯ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি শামসুল আলম বলেন, গত দুয়েক বছরে প্রত্যাবাসন সম্পর্কে কিছু কিছু কথা উঠে, তা আবার বিফলে যায়। দুই দেশের প্রতিনিধি দল বৈঠক-মিটিং করেছে। এমনকি মিয়ানমারে পরিদর্শনেও গিয়েছিল। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া কেন বন্ধ হয়ে গেল জানিনা। আমরা নিজেরাও দীর্ঘদিন অন্য দেশে থাকতে চাচ্ছি না, আমাদের নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গা কমিউনিটির দাবিগুলো মেনে নিয়ে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরু করলে আমরা চলে যাবো।
উখিয়া কুতুপালং ১ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (ওয়েস্ট) উপনেতা হামিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এত বড় রোহিঙ্গা কমিউনিটি নিজেদের অধিকার আদায় করে স্বদেশে ফিরতে পারবে কিনা জানিনা, তবে আমরা শিগগিরই নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে চাই। এদেশে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাই দুই দেশের সরকার বিষয়টি আন্তরিকভাবে দেখলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সফল হবে বলে মনে করি।
রোহিঙ্গারা বলছেন, ক্যাম্পের জীবন জরাজীর্ণ এবং গণবসতি। অনেকটা একঘেয়ে এবং খাঁচায় বন্দির পাখির মত জীবন অতিবাহিত করেছেন টানা ৭ বছর ধরে।
উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া ১ নম্বর ক্যাম্পের রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ডা. জুবায়ের জানান, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। কিন্তু এর আগে আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়রত ছিল। ৩৩টি ক্যাম্পে বসবাস করে একটি বন্দি জীবন যাপন করছেন তারা।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন যাবৎ জাতিসংঘের পক্ষে খাদ্য সহায়তা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে এ সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। কখন জানি বন্ধ হয়ে যায়। এই শরণার্থী জীবন খাঁচায় বন্দির মতো। আমরা স্বদেশে ফিরতে চাই।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরও ক্ষীণ হয়ে উঠেছে :
বারবার প্রত্যাবাসনের আলোচনা হলেও একজনও ফিরতে পারেননি তাদের স্বদেশ মিয়ানমারে। এর মধ্যে জাতিসংঘ খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় তাদের জীবন আরও কষ্টকর হচ্ছে। এ জীবনের বিপরীতে স্বদেশ ফিরে মুক্ত জীবন চান তারা। এ জন্য দ্রুত সময়ে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ গ্রহণের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছেন রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পর ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মংডু আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউয়ের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যর প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে আসে। সে সময় ৭ দিনে ১৪৭টি পরিবারের প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই শেষে ২২ মার্চ তারা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন।
ওই সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয় থেকে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে পরিচয় যাচাই-বাছাই করেছে। পাইলট প্রকল্পের আওতায় তাদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ওই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানানো হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।
পরে একই সালের ৫ মে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের উপযোগী কী না দেখতে মিয়ানমার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে অবস্থানরত ২০ রোহিঙ্গাসহ ২৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল। ওইদিন টেকনাফ টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি দিয়ে একটি স্পিড যোগে প্রতিনিধি দলটি রাখাইনের মংডুর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এই দলে ২০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও ছিলেন।
২০২৪ সালের ১২ মে তৎকালীন পররাষ্টমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির দ্বিতীয় সভায় বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনোখুনি, মাদকসহ নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যাবে।’
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান যুদ্ধ ও বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা আরো দূরে সরে গেছে বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী খোকা বলেন, ‘যেভাবে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বাড়ছে, তাতে উখিয়া-টেকনাফ ছাড়াও পুরো কক্সবাজার হুমকির মুখে পড়েছে। আবার ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদক ব্যবসা নিশ্চয় আমরা স্থানীয়রা আছি তাদেরও জন্যেও হুমকি। সবাই চায় অতি দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হোক। কিন্তু মিয়ানমার অভ্যন্তরে চলমান যুদ্ধ আর বাংলাদেশের বৈরী পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন দূরে সরে গেছে।’
অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের আগমনের সাত বছর অতিবাহিত করেছে। মিয়ানমারের রাখাইনে চলমান যুদ্ধ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি আরো পিছিয়ে গেছে। ২৫ আগস্ট দিনটি উপলক্ষে প্রত্যাবাসন দাবিতে রোহিঙ্গারা সভা, সমাবেশ করবে। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার থাকবে।’