বাইকের পেছনে বসে চালকের গলায় ছুরি চালাল ঘাতক

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ রাজধানীর মগবাজার-মৌচাক ফাইওভারে দুর্বৃত্তের ছুরিতে আহত এক মোটর সাইকেল চালকের মৃত্যু হয়েছে। দুর্বৃত্তরা তার মোটর সাইকেলটিও নিয়ে গেছে। মো. মিলন মিয়া (৩৫)। পেশায় ছিলেন একজন প্রাইভেট কারচালক।

দুই সন্তানের জনক মিলন পরিবার নিয়ে মিরপুর ১ নম্বরের গুদারাঘাট এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। গ্রামের বাড়ি ভোলা জেলায়। সংসারের খরচ চালাতে রাতের বেলায় মোটর সাইকেলে রাইড শেয়ারিং অ্যাপসের মাধ্যমে পাঠাও এবং উবারে যাত্রীসেবা দিতেন। সেই পাঠাওয়ের যাত্রীবেশে থাকা এক ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে প্রাণ গেল মিলনের। ছিনতাইকারী তার মোটরসাইকেল ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়।

গতকাল রোববার রাতে শান্তিনগর ফ্লাইওভারের ওপরে এই ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকারী তার বাইকের পেছন থেকে গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়। ছুরির আঘাতে বড় ক্ষতের সৃষ্টি হয় তার গলায়। এমনকি কেটে যায় শ্বাসনালীও। প্রাণ বাঁচাতে নিজের কাটা গলায় হাত দিয়ে চেপে ধরে ফ্লাইওভার থেকে নিচে দৌড়ে নামেন মিলন। সেখানকার স্থানীয় জনতা এবং পুলিশের সহযোগিতায় তাকে দ্রুত নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়। পরে সেখানেই মারা যান মিলন।

আজ সোমবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে থাকা নিহত মিলনের স্বজন ও পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

মিলনের ভাই হিমেল বলেন, ‘মিলন প্রাইভেট কার চালাত। কিন্তু কিছু দিন থেকে বাড়তি উপার্জনের জন্য রাতের বেলায় পাঠাওয়ে বাইক চালাত। গতকাল রাতে সে বাসা থেকে আগের মতোই মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন। রাত দেড়টার দিকে মিলন আমাদেরই সিএনজিচালক এক বন্ধুকে ফোনে জানায় যে, সে রাজারবাগ এলাকায় একটি ভাড়া পেয়েছে। সেই ভাড়াটি শেষ করেই বাসায় ফিরবে। কারণ তার বাইকে তেল কম ছিল। এরপর রাতে ২টার দিকে ৪০ মিনিটের দিকে আমার ফোনে একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে। ফোনে জানায়, মিলনের গলায় ছুরি মারা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খবর পেয়েই আমি এবং মিলনের বাবা ঢাকা মেডিকেলে যাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, শান্তি নগরের ফ্লাইওভারের ওপরে তার বাইকটি ছিনতাই হয়েছে। মিলন কাঁটা গলা চেপে ধরে নিচের দিকে নেমেছিল। হাসপাতালে মিলন আমাকে ইশারায় বোঝায় যে, তার পেছনে থাকা যাত্রী গলায় ছুরি মেরেছে।’

ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে নিজের গলা চেপে ধরে মিলন যখন ফ্লাইওভারের নিচে দৌড়ে নামে, তখন পাশেই অবস্থান করছিলেন পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মোজাম্মেল। মূলত তিনিই মিলনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান।

এসআই মোজাম্মেল  বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটে তিনতলা ফাইওভারের ওপরে। ওটা শাজাহানপুর থানা এলাকায়। কিন্তু মিলন যে দিক থেকে নেমেছিল সেটা আমাদের এলাকা। আমি সেখানে ডিউটিতে ছিলাম। মিলনের পাশে এসে দাঁড়ানোর পরে দেখি তার পুরো শরীর রক্তে ভেজা। রক্ত বন্ধ করতে নিজের দুই হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে ছিলেন। তার চোখে ছিল বাঁচার আকুতি। যা আমি এখনো ভুলতে পারছি না। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি নাম বা কারো মোবাইল নাম্বার আছে কি না। সে মুখে কোনো কথা বলতে পারছিলেন না। তবে অনেক কষ্টে মোবাইলে তার এক স্বজনের নাম্বারটা তুলে দেয়। এরপর আমি দ্রুত তাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে তুলি।’

এসআই আরও বলেন, ‘মিলনকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে তার অপারেশন করা হয়। ততক্ষণে তার বাবাসহ অন্যরাও চলে আসেন হাসপাতালে।’

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পুলিশের একটি টিম যখন মিলনকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয়। তখন অপর একটি টিম চলে যায় ফ্লাইওভারের ওপরে। সেখানে গিয়ে তারা রক্তমাখা চাকু এবং মিলনের ব্যবহার করা হেলমেটটি খুঁজে পায়। পরে এসব জিনিস শাজাহানপুর থানা পুলিশের কাছে বুঝিয়ে দেয় পল্টন থানা পুলিশ।

নিহত মিলনের বন্ধু রানা বলেন, ‘আমরা যখন ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে গেলাম। তখন দেখি ওর গলায় সেলাই করা হচ্ছে। আমাকে দেখে আমার হাতটি চেপে ধরল মিলন। বুঝতে পারলাম আমাদের দেখে সে কিছুটা সান্ত্বনা পেয়েছে। এরপর তাকে হৃদরোগ হাসপাতালে নিয়ে আসতে বলল ডাক্তার। আমরা দেরি না করে খুব দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে এলাম।’

তিনি আরও বলেন, ‘হাসপাতালে নিয়ে আসার পর দেখি জরুরি বিভাগের সবাই ঘুমাচ্ছেন। তারা আমাকে দ্রুত রক্ত জোগাড় করতে বললেন। আমরা অনেক বন্ধুরা মিলে তাকে রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত হলাম। কিন্তু মিলন দেখি স্টেজারে শুয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করছে। তখন আমি গিয়ে ওকে আগলিয়ে ধরি। এমন সময় সে জিহ্বা বড় করে বের করে মুখ হা করে নিঃশ্বাস ছেড়ে দিলো। আমার হাতেই প্রাণ গেল ওর।’

বাবার লাশের ময়নাতদন্ত চলছিল মর্গে। আর বাইরে চিৎকার করে কাঁদছিলেন মিলনের দুই স্বজনেরা। তবে কোথাও দেখা মিলছিল না মিলনের স্ত্রী এবং সন্তানের। পরে কথা বলে জানা যায়, মিলনের স্ত্রী শিল্পী থানায় গেছেন মামলা করতে। আর মিলনের ১০ বছরের ছেলে মিরাজ ও পাঁচ বছরের মেয়ে সাদিয়াকে বাসায় রাখা হয়েছে। কারণ কোনোভাবেই তাদের কান্না থানানো যাচ্ছে না। অভাবের সংসারে স্বামীকে ছাড়া কীভাবে মিলনের স্ত্রী তার দুই সন্তানকে লালন পালন করবেন তা নিয়ে চিন্তিত তার স্বজনরা।

 

Print Friendly

Related Posts