সহযোগী আরমানসহ সম্রাট গ্রেফতার, সম্রাটের জুয়ার সাম্রাজ্য ছিল বিশাল

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ অবশেষে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। চলমান ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের ধারাবাহিকতায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রোববার ভোর ৫টায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী আরমান কে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট চলমান ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযানের শুরু থেকে তাদের নজরদারির মধ্যেই ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও চালিয়েছিলেন। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে তিনি দেশ ছাড়তে পারেননি।

একাধিক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন সম্রাট। এ সময় তিনি গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিলেন। ঢাকায় তিনি প্রভাবশালী নেতার বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। গত কয়েক দিন ধরে তিনি বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এদিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের যে এলাকা থেকে সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়েছে সেই কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রামটি সীমান্তের কাছাকাছি। ধারণা করা হচ্ছে সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রামের যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেটি সম্রাটের আত্মীয়ের বাসা। বাড়িটি মনিরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির। তবে তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় এখনও পাওয়া যায়নি। কুঞ্জুশ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গভীর রাতে ওই এলাকায় একটি বাড়ি র‌্যাব ঘিরে রাখে। পরে সম্রাটকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

 

সম্রাটের সাম্রাজ্য

 

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। রাজধানীর ক্লাবগুলোতে যাতায়াতকারীদের কাছে তিনি ক্যাসিনো সম্রাট হিসেবে পরিচিত। যুবলীগের রাজনীতি করলেও তার নেশা ও পেশা জুয়া খেলা। জুয়ার ব্যবসা করে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। তিনি মাসে অন্তত একবার সিঙ্গাপুরে যেতেন, জুয়া খেলতে, ১০ দিন থাকতেন। তার জুয়ার আসর থেকে কেউ-ই জিতে আসতে পারেন না। মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টন এলাকাসহ অন্তত ১০টি ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।

যুবলীগ নেতা সম্রাট ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি চাঁদাবাজিতেও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জাকাত ও দানের টাকা দিতেন আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামে। সেখান থেকেও চাঁদা নিতেন সম্রাট। যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মতো একটি বড় ইউনিটের সভাপতি হওয়ার সুবাধে তার ছিল বিশাল বাহিনী। তিনি কাকরাইলের অফিসে অবস্থান করলেও কয়েকশ’ নেতাকর্মী সবসময় তাকে ঘিরে রাখত। অফিস থেকে বের হয়ে কোথাও গেলে তাকে প্রটোকল দিতেন শতাধিক নেতাকর্মী। অবৈধ উপার্জনের টাকা দিয়েই এ বাহিনী পালতেন সম্রাট।

সম্রাটের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯০ সালে। সেই সময়কার ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। তখন সারাদেশে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। সম্রাট রমনা অঞ্চলে আন্দোলনের সংগঠকের দায়িত্বে ছিলেন। এ কারণে তখন নির্যাতনসহ জেলও খাটতে হয় তাকে। এর পর থেকেই ‘সম্রাট’ খ্যাতি পান সাহসী সম্রাট হিসেবে।

যুবলীগ সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরীর জন্ম ফেনীর পরশুরাম উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের পূর্ব সাহেবনগর গ্রামে। তার বাবা ফয়েজ আহমেদ ছিলেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। বাড়ি পরশুরামে হলেও সেখানে তাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় বড় হন সম্রাট।

সম্রাটের বড় ভাই বাদল চৌধুরী ঢাকায় তার ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। ছোট ভাই রাশেদ ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। তার বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। মা বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর সম্রাটের পরিবারের সবাই গা ঢাকা দিয়েছেন। সম্রাট থাকতেন মহাখালীর বাসায়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক দিন ধরে তিনি বাসায় নেই।

সম্রাট ১৯৯১ সালে ছাত্রলীগের রাজনীতি করা অবস্থায় এরশাদ সরকারের পতনের পর ক্ষমতায় আসে বিএনপি সরকার। সে আমলে সম্রাটের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। ১/১১-এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সময় সম্রাট যুবলীগের প্রথমসারির নেতা ছিলেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে। এর পর থেকেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হতে থাকেন সম্রাট। দলীয়ভাবে পদোন্নতিও হয় তার। আওয়ামী লীগের বড় বড় অনুষ্ঠানে পরিচিত মুখ হিসেবে উপস্থিত থাকতেন।

যুবলীগের সবশেষ কাউন্সিলে তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন। আগের কমিটিতে তিনি ছিলেন একই ইউনিটের সাংগঠনিক সম্পাদক। দক্ষিণ যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা মিল্কীর হত্যাকাণ্ডের পর সম্রাটের আর পিছু তাকাতে হয়নি। মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলকায় অপরাধ জগতের একক আধিপত্য তৈরি করেন সম্রাট। তিনি ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

সম্রাটের ঘনিষ্ঠ দুই সহচর হলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদ (কাউন্সিলর) ও সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। যুবলীগের অপর প্রভাবশালী নেতা জিকে শামীমও সম্রাটকে অবৈধ আয়ের ভাগ দিতেন। সাঈদকে কাউন্সিলর বানান সম্রাটই। পরে তাকে দিয়ে ক্যাসিনো ব্যবসা দেখভাল করাতেন তিনি।

সম্রাট ছিলেন ঢাকায় ক্ষমতাসীন দলের অন্যতম সক্রিয় কর্মী। ঢাকায় দলীয় সমাবেশগুলো সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন তিনি। টাকা ও জনবল সরবরাহের কাজ করতেন সম্রাট। এসবের মাধ্যমে যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। ওমর ফারুক চৌধুরী সম্রাটকে যুবলীগের শ্রেষ্ঠ সংগঠক ঘোষণা করেন।

সম্প্রতি ক্যাসিনো চালানো, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিসহ সব অভিযোগের তীর এখন যুবলীগের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের দিকে। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি রাজধানীর মতিঝিলসহ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার সরকারি দফতর, ক্লাবসহ বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

কে এই আরমান?

 

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সম্রাটের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা যেসব যুবলীগ নেতা পরিচালনা করতেন, তার মধ্যে আরমান অন্যতম। সম্রাটের পরেই ক্যাসিনোবাণিজ্যে তার নাম উচ্চারিত হতো। ক্যাসিনোবাণিজ্যে আরমানকে গুরু বলে মানতেন সম্রাট।

আরমানের উত্থানটা ঘটে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম এলাকা থেকে। নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে বায়তুল মোকাররমে লাগেজ বিক্রি করতেন তিনি। এর মাঝেই খালেদা জিয়ার নিকটাত্মীয় ‘বাউন্ডারি ইকবাল’ হিসেবে পরিচিত ইকবাল হোসেনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ইকবালের মাধ্যমে হাওয়া ভবনে যাতায়াত শুরু করেন আরমান। সেই সময় ক্ষমতায় থাকা বিএনপির ছত্রছায়ায় মতিঝিল ক্লাবপাড়ায় প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন তিনি।

সেই প্রভাব খাটিয়ে বিএনপি আমলেই ফকিরাপুলের কয়েকটি ক্লাবের ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রণ নেন আরমান।

এর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে যুবলীগে ভিড় জমান আরমান। সম্রাটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা শুরু করেন। সম্রাটের বিভিন্ন অপকর্মে শামিল হন। সম্রাটকে মতিঝিল ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনোবাণিজ্যে প্রবেশ করান তিনি। সম্রাটকে সামনে রেখে ক্যাসিনোবাণিজ্যের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

সম্রাট ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি হলে সহসভাপতির পদটি বাগিয়ে নেন আরমান। নিজের টাকা দিয়ে তিনি প্রথমে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম কিনে আনেন ঢাকায়।

 

সম্রাটের ৩ স্ত্রী

 

ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাটের তিনজন স্ত্রী রয়েছেন। এর মধ্যে একজন বিদেশি স্ত্রী আছে বলেও জানা গেছে। সম্রাটের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে গণমাধ্যমে এ খবর বেরিয়েছে। পারিবারিক সূত্র জানা গেছে, সম্রাটের দুই স্ত্রী। প্রথম পক্ষের স্ত্রী বাড্ডায় থাকেন। প্রথম পক্ষে সম্রাটের এক মেয়ে। তিনি পড়াশোনা শেষ করেছেন।

সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী মহাখালীর ডিওএইচএসে থাকেন। তার এক ছেলে। তিনি মালয়েশিয়ায় এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সিঙ্গাপুরে সম্রাটের বিদেশি একজন স্ত্রী আছে বলেও পারিবারিক সূত্রটি জানায়। তবে ওই স্ত্রীর ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সূত্রটি জানিয়েছে, সম্রাট মহাখালীতে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসাতেই স্থায়ীভাবে থাকতেন। তবে দুই বছর ধরে তিনি বাসায় যেতেন না। কাকরাইলে নিজের কার্যালয়ে থাকতেন। তবে বাসার বাইরে থাকলেও গাড়ির চালকের খরচসহ পরিবারের সব খরচ দিতেন সম্রাট।

সম্রাটরা তিন ভাই। এক ভাই ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন। আরেক ভাই সম্রাটের ক্যাসিনো ব্যবসা দেখাশোনা করতেন। সম্রাটের মা ভাইদের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন। সম্রাটদের গ্রামের বাড়ি ফেনীতে।

 

সম্রাট ও আরমান যুবলীগ থেকে বহিষ্কার

 

অসামাজিক কার্যকলাপ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজে জড়িত থাকায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও সহ সভাপতি আরমানকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

রোববার যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি এই দুজনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানায়। কেন্দ্রীয় যুবলীগের শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক মিজানুল ইসলাম মিজু রোববার দুপুরে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

Print Friendly

Related Posts