প্রধানমন্ত্রীর সাদা মনের মানুষ সন্ধান

॥ মোল্লা জালাল ॥

 

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দলের জন্য সাদা মনের মানুষের কথা বলেছেন। তাঁর এই কথার সরল অর্থ হচ্ছে যারা রাজনীতির বেপারি নয় কিংবা রাজনৈতিক অবস্থানকে বিক্রি করে অর্থ-বিত্ত ধন-সম্পদের ধান্ধায় থাকে না সেই সব মানুষ তাঁর প্রয়োজন। যারা দলের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য শ্রম ও মেধা দিয়ে কাজ করবে। তিনি চান সেই মানসিকতার কর্মী, যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করবেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, সেই মানুষ কোথায় পাওয়া যাবে। আমাদের সমাজের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য যারা হাঙ্গামা করেন তারা কমবেশি সবাই নিজের জন্যই রাজনীতি করেন। যার ফলে দায়িত্ব পাওয়ার পর খুব কম সংখ্যক নেতা-কর্মী পাওয়া যায় যাদের বিরুদ্ধে কোন না কোন অনিয়ম-অনাচারের অভিযোগ উঠে না।

এর মধ্যে ব্যতিক্রম যে একেবারে নেই তা নয়। যেমন প্রয়াত আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। তিনি মন্ত্রীত্ব করেছেন, দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে রিজভী আহমেদও অসচ্ছতার কোন অভিযোগ আনতে পারেননি। তিনি কতোটা সক্ষম কি অক্ষম ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, কিন্তু তিনি অস্বচ্ছ ছিলেন না। যার ফলে তাকে দৃষ্টান্ত ধরা যেতে পারে।

মানুষ অসৎ এবং আপসকামি হয় লোভ-লালসা আর প্রাণের ভয়ে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে যখন দেশে আসেন তখন তাঁর চোখে বাংলাদেশটা ছিল একটা ঘাতকের দেশ। যে দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্থপতি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করতে পারে।

মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধু তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের ভালবাসতেন। তাঁর ভালবাসাটা ছিল অন্য রকমের। সেটা কর্মীর প্রতি নেতার রাজনৈতিক ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ছিল না। তিনি দলের নেতা-কর্মীদের ভাল বাসতেন স্বজনদের মতো, যেন সবাই আত্মীয় বা একই পরিবারে লোক। তাঁর এই ভালবাসার শক্তিই গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। যে কারণে পাকিস্তানের মতো জুলুমবাজ শাসকদের বিরুদ্ধে তিনি এদেশের ছাত্র-জনতাকে এক কাতারে এনে স্বাধীনতার সংগ্রামকে বেগবান করে বাঙালি জাতিকে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দলের নেতা-কর্মীদের ভালবাসতেন, বিশ্বাস করতেন।

তাঁর নেতৃত্বে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ ছিল বলেই তিনি আশে-পাশে মোশতাক কোরবানদের দেখতে বা ভাবতে পারেননি। তাঁর হুকুমে লাখ লাখ বাঙালি মক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছিল বলে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একজন জিয়া কিংবা সেনাবাহিনীতে ডালিম-হুদাদের চিনতে পারেননি। কারণ সমকালিন পৃথিবীর ইতিহাসে একজন মানুষের হুকুমে এভাবে জীবন দিয়ে কোন জাতি মুক্তিযুদ্ধ করেনি। যার ফলে তিনি সবাইকে তাঁর আপনজন মনে করতেন।

জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর জীবনের ক্রমাগত বেড়ে উঠায় পিতা-মাতাকে দেখেছেন, কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, কিভাবে ভালবাসে। সেই মানুষেরা যখন তাঁর পিতা-মাতা ভাই বেরাদর সবাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে, তখন তাদের কারো ওপর শেখ হাসিনার আস্থা থাকার কথা নয়। তাই বলছি, তিনি ৮১ সালে ঘাতকদের দেশে আসেন। এই আসার মূল শক্তি ছিল তাঁর সাহস, আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল। তাঁর ওপরও কম হামলা হয়নি। তাঁকেও মেরে ফেলার জন্য বহুবার আক্রমণ হয়েছে। সর্বশেষ ভয়াবহ আক্রমণ ছিল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। কিন্তু এতো কিছুর পরও তিনি দমে যাননি। অদম্য সাহসে সব কিছু মোকাবেলা করে চলেছেন। তিনি লক্ষ্যে অবিচল। তাই অসচ্ছতা-অসততা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। ক্রমাগতভাবে তিনি আজ গোটা জাতির সাহসে পরিণত হয়েছেন। যার খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। সেই তিনি তাঁর দলটিকে ঢেলে সাজানোর জন্য সাদা মনের মানুষ খুঁজছেন।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী ৭টি এবং ভাতৃপ্রতিম ২টি সংগঠন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আওয়ামী লীগের ছাতার নীচে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামালসহ ভাবমূর্তি ও আদর্শের নামে যে কত সংগঠন আছে তা বোধ হয় দলের কেন্দ্রীয় দফতরও জানে না।

সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও কার্যকর ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সে সময়ে ছাত্র ছাড়া কেউ ছাত্রলীগ করেছে এমন উদাহরণ আমার জানা নেই। ১৯৬৯ সালে আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি। ৭০ সালে ক্লাশ টেনে এবং ৭১ সালে মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলাম। যুদ্ধের কারণে পরীক্ষা দেইনি। পরে দেশ স্বাধীন হলে ৭২ সালে মেট্রিক পাশ করি। সুতরাং ওই বযসে কিছুই বুঝিনি, কিছুই দেখিনি এমন নয়। সবই দেখেছি, সব কিছুই বুঝতাম। সবক্ষেত্রেই ছাত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতাম। সেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব কিংবা সদস্য মনোনীত করার ক্ষেত্রে এখন আগে দেখতে হয় তার কয়টা বউ, কে কয় ছেলে-মেয়ের বাপ।

আমাদের সময়ে স্কুলের ক্লাশ ক্যাপ্টেন বলে একটা রেওয়াজ ছিল। ক্লাশের ফার্স্ট বয় সব সময় ক্লাশ ক্যাপ্টেন হতো। এতে একটি সুবিধা ছিল, ক্যাপ্টেন হওয়ার জন্য কোন দলাদলি, গোলাগুলি করতে হতো না। যিনি ফার্স্ট বয় তিনিই ক্যাপ্টেন। সুতরাং ক্যাপ্টেন হতে হলে ফার্স্ট বয় হতে হয়। এখন হয় তার উল্টো। যদি নিয়মটি এভাবে সোজা করে দেওয়া যেতো যে, স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ব্রিলিয়েন্ট ছেলে বা মেয়ে হবে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যান্য পদাধিকারি, তাহলে কি সংগঠনের চেহারা পাল্টে যেত না। ভাবমূর্তি উজ্জল হতো না। দলাদলি বা গোলাগুলির কোন প্রয়োজন হতো? আমরাই বলি ছাত্ররাই আগামী দিনে দেশের দায়িত্ব নেবে। তার আগে তারা যদি লেখা পড়াই না করে, নেতৃত্বের গুনাবলি অর্জনে ব্যর্থ হয় তবে তারা কি নের্তৃত্ব দেবে।

একইভাবে আওয়ামী লীগের সবগুলো সহযোগী সংগঠনকে ঢেলে সাজানো যেতে পারে। এর মধ্যে দু’টি সংগঠনের ক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা আছে। একটি যুবলীগ আরেকটি সেচ্ছাসেবক লীগ। কারণ, এ দু’টি সংগঠনের বাউন্ডারি নেই। যে ব্যক্তি বয়সে যুবক সেই যুবলীগ করতে পারে। তেমনি সেচ্ছাসেবক লীগও। শিশু বা কিশোর তো সেচ্ছাসেবক হয় না। এ দু’টি সংগঠনের নেতা-কর্মী বাছাই করা একটু মুশকিল।

কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা লীগ-এগুলো গোছানোতে কোন সমস্যা নেই। এখন কৃষক লীগের নেতা যদি শিল্পপতি হয় তাহলে যা হবার তাই হবে। ওই দলে কোনকালেই কোন কৃষক সম্পৃক্ত হবে না। প্রশ্ন হচ্ছে কৃষক কে ? কৃষি প্রধান বাংলাদেশ সত্যিকার কৃষকের অভাব নেই। বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, কৃষক লীগের নির্বাচন করা। যারা পোলট্রি , ফিসারি, গ্রোসারি, গরু মোটাতাজাকরণ খামারের মালিক বা যারা এগ্রো ফার্ম করেন তারা কেউ কৃষক নয়। তারা শিল্পপতি। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের বেশিরভাগ এফবিসিসিআই’র সদস্য। দরকার হলে তাদের জন্য ‘খামারি লীগ’ করে দেওয়া যেতে পারে। কৃষক লীগ নয়। কৃষক লীগের নেতারা রাজধানীতে বসবাস করলে দলের পদ-পদবি বেচা-কেনা করবে নাতো কি করবে।

অনুরূপভাবে শ্রমিক লীগ। শিল্পপতি যদি শ্রমিক লীগের নেতা হন তবে তিনি দল দিয়ে ব্যবসা করবেন এটাই স্বাভাবিক। শ্রমিক লীগের নেতা-কর্মীদের অবশ্যই বাস্তবে শ্রমিক হতে হবে। তবেই শ্রমিক লীগ শ্রমজীবী মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে।
পেশাভিত্তিক দলীয় নেতা-কর্মীদের আইডেন্টিফাই করা হলে আপনা থেকেই সাদা মনের মানুষ দলে ভিড়বে। রাজনীতি সচ্ছ হবে। এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা দলের কতটি সহযোগী সংগঠন রাখবে। না হলে প্রতিনিয়ত সুবিধাবাদী ধান্ধাবাজ লোকেরা একেকটা নতুন দোকান খুলবে। একটি রাজনৈতিক দলে বিশৃঙ্খলা ও অনাচারের সৃষ্টি হয় সেখান থেকেই।

বাংলাদেশে কোন কৃষক বা শ্রমজীবী মানুষ র্দুনীতি করে না। বিদেশ থেকে যারা রেমিটেন্স পাঠায় তারা পরিশ্রম করে। দুর্নীতি করে টাকা কামাই করে না। কৃষক দুর্নীতি করে বিত্তবান হয় না। দুর্নীতি করে শিক্ষিতদের একটি শ্রেণী। যারা মেধা-বুদ্ধিতে চতুর। এই চতুর শ্রেণী ‘দুর্নীতির ডায়বেটিসে’ আক্রান্ত। এরাই দেশের সর্বনাশ করে। ডায়বেটিকস যেমন নির্মূল হয় না, নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তেমনি দুর্নীতিও একেবারে নির্মূল করা সম্ভব নয়। কারণ লোভ-লালসা থেকে দুর্নীতির বিস্তার ঘটে। সুতরাং এটা নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। এমন কৌশল, যাতে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ হলে একেবারে পথের ভিখারি হতে হয়। দুর্নীতিবাজদের নিঃস্ব করে দেওয়াই হবে সবচে বড় থেরাপি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশটাকে যে উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান তার অন্যতম প্রতিপক্ষ হচ্ছে দুর্নীতিবাজ লোকেরা। এরাই রাজনীতি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে নষ্ট করে। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। যারা বাদ পড়েছেন তারাতো গেছেনই, যারা আছেন তাদের মকসুদটাও বুঝতে হবে। তাদের কার কি পেশা। তারা কে কি করেন, কি চান। সংস্কারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, শৃঙ্খলা ও ভয়ের দেয়াল না থাকলে শুধু লোক বদল হবে। কিছুদিন পর দেখা যাবে পুনরাবৃত্তি। সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন হচ্ছে এবং সামনে আরো হবে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সবাই দৌঁড়াচ্ছে দলের নেতাদের বাসা-বাড়িতে। কাউন্সিলরদের নিয়ে কারো মাথা ব্যাথা নেই। আগে যারা নেতৃত্বে ছিলেন তারাও এভাবেই দৌড়ঝাঁপ দিয়েই নেতা হয়েছিলেন। এখনকার নেতারও সে রাস্তাটাই চেনেন। যদি এমন হয় জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে কাউন্সিলররা নেতা নির্বাচনে ভোট দেবেন আর ভোটের ফল ঘোষণা করবেন সভানেত্রী, তাহলে বুঝা যাবে কর্মীরা আসলে কাকে নেতা হিসেবে দেখতে চায়। ছাত্রলীগ এখনো বদলায়নি। অনেক জায়গা থেকেই নানা রকমের খবর আসে প্রতিদিন। অন্যান্য সহযোগী সংগঠনেও চলছে বেসুমার দলাদলি। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সংস্কারে হাত দিয়ে থেমে গেলে ভয়ানক অনাচারের সৃষ্টি হয়। সুতরাং সংস্কার সম্পন্ন করতেই হবে। এর কোন বিকল্প নেই।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আপোহীনতার প্রতি বাঙালি জাতির যেমন আস্থা ছিল তেমনি জননেত্রী শেখ হাসিনার সচ্ছতা ও দৃঢ়তার প্রতিও জাতির মনে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হুকুমে বাঙালি যেমন জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তেমনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সম্ভব ভয়াবহ দুর্নীতিবাজদের লোভের থাবা থেকে দেশটা রক্ষা করে আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়া। কারণ,তিনি আপোসকামী, ভীতু ও লোভী নন। তাঁর স্বপ্ন আছে। তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন। তাঁর এই আগামীর পথে হাঁটায় সাদা মনের মানুষ সঙ্গী দরকার। ওই মানুষ এই দেশেই আছে। তাদের মনে শুধু বিশ্বাসের বীজ রোপন করে দিতে হবে। সাদা মনের মানুষেরা কাউকে ভয় পায় না, তারা কোন চ্যালেঞ্জ নিতেও পিছপা হয়না। তারা দুর্বল হয় শুধু দুর্নীতির শিকার হলে।

 

লেখক:  সিনিয়র সাংবাদিক, বিএফইউজে’র সভাপতি।

Print Friendly

Related Posts