দেশপ্রেমের চিঠি ও মওলানা ভাসানী

মোমিন মেহেদী  []

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী নিরন্তর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন নতুনধারার রাজনীতিকগণ নিবেদিত থাকে কালোহীন আলোকিত দেশ-সমাজ আর রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে। তিনি যে কতটা আন্তরিক আর রাজনীতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য অনেক দূর যেতে হবে না নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদেরকে। এই চিঠিটার দিকে একটু চোখ রাখলেই বোঝা যাবে মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক কৌশল কতটা দৃঢ় ছিলো। তিনি বাংলাদেশের বন্ধুদেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতীকে লিখেছেন-

‘প্রিয় শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী,
প্রধানমন্ত্রী
আমার আন্তরিক আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানিবেন। আমার পত্রের উত্তর মি. কাউলের মেসেজে বিস্তারিত অবগত হইয়া যারপরনাই খুশি হইলাম। আমার বাল্যজীবনের আদর্শ ৮৯ বছর যাবত অটুট রাখিয়াছিলাম। স্বৈরাচার এহিয়া সরকারের অমানুষিক অত্যাচারে উহা লঙ্ঘন করিতে হইল। বর্তমানের রাজনীতিবিদ কংগ্রেসের কর্মীদেরকে যে যাহাই বলুক কিন্তু তাহাদের মত বিলাসিতাশূন্য জীবনযাপন ও নির্মল চরিত্র অনেকেরই নাই। আমি চিরদিন সাধারণ গৃহে সাধারণভাবে নির্জন পল্লীতে থাকিয়া দেশের সেবা করিয়াছি। কিন্তু এবারই তাহার ব্যতিক্রম হইল। গত ৭ মাস শহরে প্যালেসেস সার্কিট হাউস বাস-আহারাদি বিলাসপূর্ণ। তাই আমার মৃত্যুকাল পর্যন্ত যাহাতে বাল্যজীবনের আদর্শ বহাল থাকে তাহারই জন্য ৫ একর জমি ও সাধারণ ধরনের ৪ খানা ঘরের ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। আমার প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় ধুবড়ীর গ্রামে। তাই আমার বৃদ্ধা স্ত্রীর আশা তাহার শেষ দাফন ধুবড়ীর কোন গ্রামে হয়। আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পোষন করি।
বাধা যতই আসুক, আমার আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস আপনাদের আশীর্বাদে অবশ্যই পূর্ণ হইবে। আমার আন্তরিক আশীর্বাদ আপনার আদর্শানুযায়ী সমাজতন্ত্র শুধু ভারতে নহে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন দরকার মনে করেন দিল্লীতে ডাকাইলেই হাজির হইব।

আপনার বিশ্বস্থ
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’

স্বাধীনতা-স্বাধীকার রক্ষার জন্য সারাদেশে সোচ্চার হওয়া আমাদের কোটি কোটি বাঙালিকে কষ্টের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি নিবেদিত থেকেছেন নির্লোভ- মোহহীনভাবে। তিনি দেরাদুন থেকে যে চিঠিটি মওলানা লিখেছেন তার মুসাবিদা সাইফুল ইসলামের। আর চিঠিটা হলো-

‘বরাবর
মিসেস ইন্দিরা গান্ধী,
প্রধানমন্ত্রী,
ভারত সরকার,
নতুন দিল্লী।
তারিখ ৩ অক্টোবর ১৯৭১
সম্মানীয়া মহাদয়া,

আপনার জন্য আমার অশেষ ভালোবাসা ও আশীর্বাদ গ্রহন করবেন। পুনরায় আপনার অমূল্য সময় হতে কয়েক মিনিট অপচয় করার কারণে আশা করি আপনি নিজ গুণে ক্ষমা করবেন।
আপনার সরকার সাধ্যমতো উত্তম চিকিৎসা করা স্বত্বেও পুরানো জ্বালাটা অনুভব করছি। কয়মাস পেরিয়ে গেছে আমি আমার স্ত্রী এবং নাতনিদের কোন সংবাদ জানি না। তাদের কোন প্রকার খবরাখবর না জানায় আমার বেদনাদায়ক অনুভব আপনি বুঝতে পারছেন- এ সম্পর্কে আমি নিশ্চিত।

বাংলাদেশের প্রথম কাতারের নেতারা যারা স্বাধীনতার জন্য কাজ করছেন তাদেরও সততা সম্পর্কে আল্লাহই জানেন। আমি পুনরায় ওয়াদা দিচ্ছি আওয়ামী লীগ যতক্ষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়বে আমি তাদের সমর্থন দিয়ে যাব।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমি যখন কলকাতায় ছিলাম তখন কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতা আপনার বরাবরে একটি লেখা টাইপ করে নিয়ে এসেছিলেন যে, অসুস্থতার দরুন আমি আপনার সাথে দেখা করতে সক্ষম হব না। চিঠির পুঙ্খানুপুঙ্খ না পড়ে কেবলমাত্র বিশ্বাসে তাতে সই দিয়েছিলাম। ওর পিছনে কি মতলব আছে আমি তা জানি না। তারা ওয়াদা করেছিলেন যে, ঐ চিঠির কপি আমাকে দেবেন। কিন্তু তারা কথা রক্ষা করেননি। আমার রাজনৈতিক জীবনে আমি ১১ বছর যাবত আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলাম এবং স্বাধীনতাউত্তরকালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করে ৮ বছর যাবত তার সভাপতি ছিলাম এবং আমি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও কৃষক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এই পদে গত ১২ বছর যাবত কাজ করে যাচ্ছি। দীর্ঘকাল এই রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সংগঠনের সভাপতির কাজে আমার পরিচালনায় কম করে হলেও ১৬ জন সেক্রেটারি কাজ করেছেন। কিন্তু আমি গ্রামেই বাস করি। ফলে জরুরী রাজনৈতিক চাহিদা মোকাবেলা করার জন্য আমার সাদা প্যাডে বহু সই তাদেরকে দিয়েছি। এসব আমি ভালোভাবে উপলব্ধি করছি তারা বিশ্বাসঘাতকতা করে আমার সরল বিশ্বাসের বহু মওকা গ্রহণ করেছে। ফলে আমার রাজনৈতিক সহযোগিতার উপর আমার বিশ্বাস চলে গেছে। এই কারণে আমার মানবিক বেদনার জন্যই এইসব অবান্তর কথা আপনাকে লিখছি।

বিশ্বশান্তি, নিপীড়িত মানুষের মুক্তি এবং আল্লায় বিশ্বাসীসহ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপনার মহৎ সংগ্রাম আপনি অব্যহত রাখবেন বলে আমি আশা ও বিশ্বাস করি। এবং আমি খোলামনে আপনার প্রতি সকল বিশ্বাসের স্বীকারোক্তি করছি। যদি কোন বিষয়ে আপনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি তবে ব্যক্তিগতভাবে আপনার সাথে সাক্ষাত করে সেই পয়েন্ট আলোচনা করব। আপনার মূল্যবান উপদেশ ব্যতীত আমি কোন সিদ্ধান্ত নেব না কোন কাজ করব না। যদি আমার বিরুদ্ধে আপনার কাছে কোন রিপোর্ট পেশ হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করুন আমি জীবনে কাউকে ঠকাইনি। এবং শেষ জীবনেও ঠকাব না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমি সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত আছি। আপনি যদি আমাকে সক্রিয়ভাবে কাজের সাথে জড়িত রাখার ব্যবস্থা করতে পারেন তবে আমি সুখী ও আনন্দিত হব। বৃদ্ধ বয়সের জন্য অনুগ্রহ করে আমাকে অবহেলা করবেন না। যদি কাজ করার এই আজীবন অভ্যাস হতে দূরে রাখা হয় তবে আশঙ্কা করছি তা আমার স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য কিছুদিন পূর্বে মি. ডিপি ধরের নিকট কিছু লেখা পাঠিয়ে তা ইংরেজি, বাংলায়, চীনা, আরবি, উর্দু, ফরাসি, রাশিয়ান, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় ছাপিয়ে এ সকল দেশে বিতরণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলাম। অনুরোধ মোতাবেক কাজ হলে আমি সুখি হব। রমজান মাসে আমি পশ্চিমবঙ্গ অথবা আসামের কোন স্থানে থাকতে চাই। পবিত্র মাস শেষে আমি আবার এখানে ফিরে আসতে চাই। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন করার লক্ষ্যে আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব। এই বুড়ো বয়সে স্ত্রী ও নাতনিদেরকে নিয়ে আসামের ধুবড়ী মহকুমার যে কোন স্থানে বাস করার জন্য যদি আপনি পাঁচ একর জমিসহ ক’টি টিনের ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে এই বদান্যতার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। আসামের আভ্যন্তরীন রাজনীতিতে আমি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না। আপনার এবং আসাম সরকারের নিকট আমি এই প্রতিজ্ঞা করছি। ছয়মাস যাবত আমার থাকা, খাওয়া, পরার জন্য আপনার উপর নির্ভরশীলতার দরুন অত্যন্ত লজ্জাবোধ করছি। যদি ধুবড়ী থাকতে আমাকে অনুমতি দেয়া হয় তাহলে সরকারী তহবিল হতে আমার জন্য অর্থ খরচের দরকার পড়বে না। যেই আমাকে প্রো-চাইনিজ বলে আপনার কাছে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা করুন, ইনশাল্লাহ আমি ভারত ও আপনার অবাধ্য হবো না।
সর্বাধিক সম্মান সহকারে
আপনার বিশ্বস্থ
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী’

প্রায় একই বক্তব্য নিয়ে আরেকটি চিঠি সেপ্টেম্বরে লিখেছিলেন ভাসানী যা ইংরেজী অনুবাদ করে ইন্দিরাকে পাঠানো হয়েছিল। কাজটি করেছিলেন তার ব্যক্তিগত সচিব সাইফুল ইসলাম। স্বপ্নজ জীবনের মালিক ছিলেন নির্মল এই রাজনীতিক। শুধু এখানেই শেষ নয়;
তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন কিংবদন্তী নেতা সাধারন মানুষের কাছে যিনি পরিচিত ছিলেন মজলুম জননেতা হিসাবে। তার সারাজীবন পর্যালোচনা করলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার সম্পর্কে বলা ‘এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত মানুষের  নেতা মাওলানা ভাসানী ’ কথাটির সত্যতা ফুটে উঠে। অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার ছিল আপসহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রাম ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ছিল পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই তাৎকালীন সরকারের যাবতীয় কালা কানুন, গনতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ ও জুলুমের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল সোচ্চার। এই চিরকালীন বিল্পবী পুরুষ কখনো আপোষ করেননি ক্ষমতা আর অর্থের সাথে এবং ক্ষমা করেননি কোন স্বৈরশাসককে। ভাসানী জীবনের সমস্ত সময়ই ব্যয় করেছেন গনমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।

১৯৪৭ সালের বিভাগ-পূর্ব সময়ে আসামে লাইন প্রথা-বাঙাল খেদাও বিরোধী  আন্দোলন থেকে ১৯৭৬ সালের ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ আন্দোলন সংগ্রামের সক্রিয় অংশগ্রহন বা নেতৃত্ব  দেয়া তার জীবন, সংগ্রামের এক মহাকাব্য। ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সিরাজগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম।  খেলাফত আন্দোলন ও কংগ্রেসের রাজনীতির মধ্য দিয়েই মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। অত্যাচারী জমিদার  শ্রেণীর জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কৃষক নেতা। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে ময়মনসিংহ থেকে মুসলমান কৃষকেরা দলে দলে আসামে প্রবেশ করে। ধারণা করা যেতে পারে সরকার ও জমিদারদের অত্যাচারে তারা আসামে যেতে বাধ্য হয়। আসামের দুর্গম এলাকাগুলোতে এসব মানুষকে জমি দিয়ে আবাদ করানো হয়। জানা যায়, এসময়ে অসংখ্য মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়। অনেকে যায় হিংস্র প্রাণী বাঘ-ভাল্লুকের পেটে। এইসব বহিরাগতেদের অকøান্ত পরিশ্রমে আসাম শস্যভান্ডারে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। এই প্রক্রিয়ায় এই এলাকায় বাড়তে থাকে বাঙালি কৃষকের সংখ্যা। বর্ণহিন্দু ও বুদ্ধিজীবীরা এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অত:পর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সরকার বহিরাগতদের একটি বিশেষ এলাকায় সীমাবদ্ধ করার জন্য ‘লাইন প্রথার’ প্রবর্তন করে এবং বাঙালি কৃষকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। মাওলানা ভাসানী নির্যাতিত কৃষকদের পাশে দাঁড়ান এবং বাংলা থেকে বহিস্কৃত হন। তিনি আসামে আশ্রয় নেন।

১৯২৯ সালের দিকে আসামের ধুবড়ির ঘাঘমারীতে খড়ের ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে ভাসানী কংগ্রেসের সাথে সম্পৃত্ত ছিলেন। একসময় তার উপলব্ধি হয়, কংগ্রেসের রাজনীতি কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষনের জন্য যথার্থ নয়। ১৯৩৭ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে মুসলিম লিগে যোগ দেন। কিছুদিনপর তিনি আসাম প্রদেশ সভাপতি ও নিখিল ভারত নির্বাহী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের জন্মের আগে ১৯৪৭ সালের ৫ মার্চ অহিংস ও অসাম্প্রাদায়িক আইন আন্দোলন শুরু হয়। ১০ মার্চ ‘আসাম দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঐদিন গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ভাসানী ব্রক্ষ্মপুত্র নদ পার হয়ে তেজপর টাউন হলে হাজার হাজার জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,‘ তোমরা উচ্ছেদ হওয়ার মাধ্যমে গৃহহারা হওয়ার চেয়ে জেলে যাও, এমনকি মৃত্যুবরন করো। যে জমিতে আছো সেই জমিতে যেন কবর হয়’। ভাসানীকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯৪৭ সালের ২১ জুন জোড়হাট জেল থেকে তিনি মুক্তি পান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরোধীদলের গোড়াপত্তন করেন মাওলানা ভাষানী। মুসলিম লীগের সাথে মতবিরোধ তৈরী হয় ভাসানীর। গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লিগ, যার সভাপতি নিযুক্ত হন মাওলানা ভাসানী।

bhashani

১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর আর্মানিটোলা ময়দানে আওয়ামী মুসলিম লীগের জনসভায় মাওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করেন। ভুখামিছিলে নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি সেক্রেটারিয়টের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে গ্রেফতার হন মাওলানা। ইতোমধ্যে মুসলিম লীগ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে-ভাষা আন্দোলনের জোয়ারে ভেসে যায় এর জনপ্রিয়তা। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়। গঠিত হয় হক-ভাসানী-সোহারওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। প্রণয়ন করা হয় ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচী, যার অন্যতম ঘোষনা ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। দেশবাসী আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সহ ২১ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন করে যুক্তফ্রন্ট জয়যুক্ত করে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসনীর মাথে সাধারন সম্পাদক হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ২ এপ্রিল মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যুক্তফ্রন্টের সভায় শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। তৈরি হয়েছিল সমঝোতার চমৎকার পরিবেশ।

১৯৫৭ সালের ৭-৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলন। ভাসানী সরকারের কাছে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দাবী জানান। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী বলেন, ৯৭% শায়ত্বসাশন হয়ে গেছে। কাগমারী সম্মেলনে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনের সিদ্ধান্ত পাশ হয়ে যায়। আওয়ামী সরকার স্বায়ত্বশাসনকে উপেক্ষা করে। প্রতিবাদে মাওলানা ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, খন্দকার মোস্তাক ভাসানীর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়, যাকে আওয়ামীলীগের নেতারা ব্যঙ্গ করে বলতেন নেহরু এইডেড পার্টি অর্থাৎ ভারতপন্থী।

ষাটের দশক জুড়ে মাওলানা ভাসনী স্বাধীনতার চেতনা সমগ্র দেশময় ছড়িয়ে দেন। কখনো পুর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন, কখনো লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা বলে দেশ উত্তাল করে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর একনায়ক আইয়ুব খান ঢাকায় এলে পল্টন ময়দানের জনসভায় দাবি করেন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী বামপন্থী ছাত্র ও কৃষক নেতা আসাদুজ্জামানের জীবনদানের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। এই সময়ে দৃশ্যত সামগ্রিক নেতৃত্ব বা জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের মুলস্রোত থেকে মাওলানা পিছিয়ে পড়েন। কিন্তু মাওলানা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্লাটফরম তৈরী করতে থাকেন। মাওলানা ভাসানী আয়োজিত কৃষক সম্মেলন থেকে শ্লোগান উঠতে থাকে ‘কৃষক-শ্রমিক অস্ত্র ধর, পর্ব বাংলা স্বাধীন কর’। মাওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার দাবিটি সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর। সব দল তখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ভাসানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলে যান উপদ্রুত এলাকায়। ঢাকায় ফিরে এসে পল্টনের জনসভায় তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ ওরা কেউ আসেনি। ওরা আমাদের কেউ না। ওরা আমাদের মানুষ মনে করে না। দেনদরকার হয়েছে। দাবী পেশ করা হয়েছে, আর নয়।’

১৯৭১ সালের ৯ জানুয়ারী সন্তোষের কৃষক সম্মেলন থেকে ভাসানী ঘোষনা দেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের কর্মসূচী সাম্য ও মুক্তির আদলে রচিত হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং সামাজিক ন্যায় বিচারে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানি ইতিহাসের পাতায় সোনালি দিনের ঘোষনা দিবে।’  শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ভাষনের পর ৯ মার্চ পল্টন জনসভায় তার উচ্চারনটি ছিল নির্ভিক। তিনি বলেন যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারবে না। ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ২৫ মার্চের মধ্যে দাবি না মানলে শেখ মুজিবের সাথে মিলে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করব। তিনি দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন, পূর্ব বাংলা স্বাধীন হবেই…

mominmahadi@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts