হাতে কোনও টাকা নেই আমার। টাকা তো নেই-ই, পয়সাও নেই। ঘরে একটা পিগি ব্যাঙ্ক ছিল, তার পয়সাগুলোও সব্জিওয়ালা আর অটোওয়ালাকে দিয়ে ফুরিয়ে ফেলেছি। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলেছি বেশ কয়েক দিন। টাকা বাতিল হওয়ার দিন আমার কাছে পাঁচশো টাকার দুটো আর হাজার

টাকার একটি নোট ছিল। ওগুলো দিয়ে গাড়ির তেল কিনেছি, আর টুকটাক বাজার করেছি। সব্জি কিনতে গিয়ে যে দিন সরকারি দোকানে পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছি, দোকানওয়ালা আইডি দেখতে চাইলেন। আইডি দেখিয়ে জীবনে এই প্রথম সব্জি কিনলাম! ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়াব কী করে? লম্বা হতে হতে বাজার ছাড়িয়ে, ইস্কুল ছাড়িয়ে, মন্দিরে গিয়ে ঠেকেছে লাইন। চেক লিখে গাড়ির চালককে পাঠিয়েছি, ছ’ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা এনেছে। পাঁচ দিন পর আবার চেক পাঠিয়েছি। না, দেবে না টাকা। টাকা পেতে হলে আমাকে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। চব্বিশ হাজার টাকা যেহেতু আমার নেওয়া হয়ে গেছে, সুতরাং আমার কপালে এ সপ্তাহে আর টাকা নেই। চব্বিশ হাজার টাকা তো ট্রেনের টিকিট কিনতেই গেছে। তার পরে এক্কেবারে হাত খালি।

এটিএমগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরেছি। বেশির ভাগের গায়ে ‘নো ক্যাশ’ সাইনবোর্ড লাগানো, আর দু’একটিতে ভয়াবহ লম্বা লাইন। এক বার এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়েও দেখেছি, মেশিনের ধারে-কাছে আসার আগেই টাকা ফুরিয়ে গেছে। ও মা, এ ভাবে বাঁচব কী করে? কার্ডে তো সব কাজ করা যায় না। মাছের বাজারে টাকা বাকি পড়ে আছে। চিকেন নিয়েছিলাম, চিকেনের ছেলেটিকেও টাকা দেওয়া হয়নি। আমি ওদের নিয়মিত ক্রেতা বলেই আমাকে বাকিতে দিচ্ছে। কিন্তু বাকি কেনারও তো একটা সীমা আছে! আজ মাছ কিনতে গিয়ে কিঞ্চিৎ অপরাধবোধে ভুগছি। মাছওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, আজও কোনও টাকা নেই হাতে, চেক নেবেন? মাছওয়ালা বললেন, নেবেন। আর আমিও নিজের জন্য, পোষা বেড়ালটার জন্য, অতিথিদের জন্য প্রচুর মাছ কিনলাম। ফ্রিজারে রেখে অনেক দিন খেতে পারি, সে কারণে বেশি করে কেনা। বেশি করে কেনার পেছনে একটা আশঙ্কাও হয়তো কাজ করছিল। কোথাও টাকা পাওয়া যাচ্ছে না আজ, হয়তো কিছু দিন পরে মাছটাছও পাওয়া যাবে না। সবাই বুঝতে পারছে টাকার অভাবটা। মাছওয়ালা অন্য কোনও দিন চেক দিতে চাইলে জানি রাজি হতো না। আজ হয়েছে। চারদিকে ক্যাশ টাকার অভাব বলেই রাজি হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বসা এক নতুন সব্জিওয়ালার কাছ থেকে সব্জি নিয়ে টাকা খুঁজছি, সব্জিওয়ালা হেসে বলল,অন্য এক দিন দেবেন। সে-ও জানে মানুষের হাতে টাকা নেই। গাড়ির ব্যাটারি লাগাতে হবে। ব্যাটারিওয়ালা কার্ড নেয় না, অগত্যা চেক নিল।

সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ দেখতে হলে ব্যাঙ্কের সামনে এক বার দাঁড়ালেই হয়। তিন-চার দিন দাঁড়িয়ে থেকে সামান্য টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে লোক। দেখলে বুক ভেঙে যায়। অনেকে আছে, তিন-চার দিন পরে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছে। শুনছি অনেকে মারাও যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়। হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হচ্ছে, নয়তো আত্মহত্যা করছে। গা কেঁপে ওঠে এ সব দেখে। মানুষের সহিষ্ণুতা দেখে আমি অবাক হয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করছে না, বরং বলছে সরকার যা করেছে ভালর জন্যই করেছে। নিরীহ মানুষগুলো ভেবে নিয়েছে কালো টাকার দিন শেষ হল।

কেউ কেউ বলছে ধনীরাও ভুগেছে, প্রচুর টাকা তাদের পুড়িয়ে দিতে হয়েছে। আমার তবুও মনে  হয়, কালো টাকার মালিকেরা খুব বেশি ভোগে না। সামান্য ক্ষতি  হলেও তারা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঠিক ঠিক পুষিয়ে নেয়, নতুন করে ধনসম্পদ করে নেয়।

 

২৪ নভেম্বর, ২০১৬