শিউল মনজুর []
প্রবাসের কঠিন জীবন উপেক্ষা করে বাংলাভাষাবাসী অনেকেই সাহিত্যচর্চায় নিজেদের জড়িয়ে রেখেছেন। বিভিন্ন দিবস পালনের পাশাপাশি সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠানও তারা পালন করে থাকেন। সেই সাথে বই ও অন্যান্য প্রকাশনার ক্ষেত্রেও তারা সমান উৎসাহী।
আবার দেশে আসলে অনেকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পেছনেই বেশি ঘুরে বেড়ান। কবি ও লেখকদের অনুসন্ধান করেন। হৃদয়ের বন্ধন তৈরী করে যান।
সম্প্রতি ইংল্যান্ডে বসবাসকারী মৌলভীবাজারের কৃতি সন্তান কবি আসমা মতিন দেশে এসেছিলেন এবং সময়টাকে সাহিত্যের পেছনেই ব্যয় করে গেছেন। এ সময় একটি বই প্রকাশ ও বইয়ের একটি প্রকাশনা উৎসবও করে গেছেন।
বইটির নাম অমরাবতী। প্রকাশক ও গীতিকার নওয়াব আলীর মাধ্যমে প্রাপ্ত অমরাবতী বইটিতে রয়েছে ৬৪টি কবিতা। শিল্পী ধ্রব এষের চমৎকার প্রচ্ছদে মোড়ানো ৭২পৃষ্টার এ বইটির মূল্য ২০০টাকা। বইটির মজবুত বাঁধাই ও ঝকঝকে ছাপা আমাদেরকে আকর্ষিত করে। কবি বইটি উৎসর্গ করেছেন তপন, রাখি, মান্না ও ফাহিমাকে। এ চারজনই কবির সন্তান এবং তাদের উদ্দেশ্য করে কয়েকটি শব্দও যুক্ত করেছেন। যা আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে সহজেই।
তিনি লিখেছেন, আমার ছেলে মেয়ে আমার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন শুধু একজন মায়ের স্বপ্ন নয়, এ স্বপ্ন একজন কবির স্বপ্ন। কবি এই স্বপ্নের পালঙ্কে আরোহন করেন। স্বপ্ন বুননের মধ্যদিয়ে নতুন দিনের পথে হাঁটেন এবং তার এই পথচলা আপনজনের মধ্যদিয়ে হলেও স্বপ্নের স্বপ্নিল বর্হিপ্রকাশঘটে কবিতার সোনালি পঙক্তির গাঁথুনি দিয়ে।
স্বপ্ন বুননের এই অমরাবতী বইটির অন্তর্গত কবিতাগুলোর মধ্যে আসমা মতিন রোপন করেছেন তাঁর ভালোবাসার কথা, স্বদেশের প্রতি অনুরাগের কথা, রোপন করেছেন আশা আকাঙ্খার কথা, মা মাটি ও মানুষের কথা এবং সর্বোপরি ব্যক্তি মানসের চাওয়া পাওয়ার বিষয়টিও রোপন করেছেন।
এখানে অমরাবতী বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা উপস্থাপন করা হলো;
আর কতবার প্রমাণিত হব
মাতৃত্বের সমতার মুখ
শতগুণ বিশিষ্ট শতকাল পূর্বে,
নির্দিষ্ট সময়ে উল্লসিত ভিড়ে,
মত্ত হয়ে প্রসব বেদনায়
এক তৃপ্ত বিজয়ানন্দের দিনে
এা হয়েছিলাম বিশ^জগতে।
বারে বারে কেন?
আমি এখন বিকশিত গোলাপ,
তুমি বুলবুল, ওষ্টকোণে ঢেলে দিও সুধা,
এক জীবন সুরের মুর্ছনায় কাটাব বিখ্যাত কাল,
গোলাপ মা এর উপমা
উভয়েই লাবণ্যে শোভিত।
(কবিতার শিরোনাম: প্রসব বেদনা, পৃষ্টা-৪৬)
এ কবিতাটির মধ্যদিয়ে মায়েদের প্রসব বেদনার বিষয়টি চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। সহজ সরলভাবে উচ্চারিত কবিতাটি সকলের ভালো লাগার কথা। তা ছাড়া ঘুমের দেশের গল্প, সূর্যমুখী প্রিয়তমা, মনখোলা বরিষণ, স্বপ্নঘুম, বৃষ্টির রাতের আনমনা, ফিরোজা বাগানে, আত্মিকথা, মোহনিয়ার নদী প্রেম প্রভৃতি কবিতা পাঠকের মনকে নাড়া দেবে বলে মনে করি।
আসমা মতিনের কবিতা জটিলতায় আবদ্ধ নয়। শব্দ ও বাক্যে সরলতা বিদ্যমান। পাঠক, পাঠের মধ্যদিয়েই কবিতার বিষয়বস্তু ও ভাবধারাকে উম্মোচিত করতে পারবেন। তাঁর কবিতায় উপমা ও অলংকারও দৃশ্যমান। এখানে কয়েকটি কবিতার উপমা ও অলংকার উল্লেখ করা হলো, এ গুলো পাঠকের মনে ভালো লাগার অনুভুতি সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।
এক. জানালার কাঁচে আকাশ নেমেছে। (কবিতার শিরোনাম; ধোয়ার গন্ধ, পৃষ্টা-৪২)
দুই. পঙ্খিরাজের পাখার বাতাস। (কবিতার শিরোনাম; ঘুমের দেশের গল্প, পৃষ্টা-৫০)
তিন. গরম চায়ের পেয়ালায় চুম্বন। (কবিতার শিরোনাম; অনন্তকালের আকাঙ্খা, পৃষ্টা-১৯)
চার. দারুচিনি সুঘ্রাণ আজও লেগে আছে কফিটেবিলে। (কবিতার শিরোনাম; একটি বিমূর্ত ছবি, পৃষ্টা-১৬)
পাঁচ. শ্বেত শ্রভ্র ধবল নতুন জাহাজে চড়ে। (কবিতার শিরোনাম; পাথরচোখের ঘুম, পৃষ্টা-১২)
সিলেটের বাসিয়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই অমরাবতী বইটি সুধি পাঠক মহলের প্রশংসা অর্জন করবে বলে আমি আশাবাদী। তিনি নিজেও কাব্যচর্চার মধ্যে থেকে আগামিতে আরো উজ্জ্বল, সুন্দর, মোহনীয় কবিতা আমাদেরকে উপহার দেবেন বলে প্রত্যাশা করি।
শিউল মনজুর : কবি ও কথাসাহিত্যিক।