নৃগোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় মৌলিক শিক্ষা

অনুপ কুমার কর  []

১. নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় : পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ

বাংলাদেশে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় বসবাস করে। চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলাসহ কক্সবাজার জেলা, সিলেট বিভাগ ও উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগ, ঢাকা বিভাগের ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা জেলা এবং বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কিছু অংশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় বসবাস করে। তবে বাংলাদেশে সঠিক কতগুলো নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় রয়েছে এবং তাদের মোট জনসংখ্যার পরিমাণ কত এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।

কোন কোন সূত্র মতে বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি নৃগোষ্ঠীর বসবাস (বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম)। এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা সংকলন সূত্রে বাংলাদেশে পৃথক পৃথক ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার সংখ্যা প্রায় ৯৬ বলে জানা যায়। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের মতে Ethnic Minority বা নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু তাদের মোট সংখ্যা প্রায় ৩.০ মিলিয়ন বা ৩০ লক্ষ বলে অনুমান করা হয়। ২০০৬ সালে ব্র্যাক এর এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে এদেশে নৃগোষ্ঠীদের সংখ্যা ২৫-৩০ লক্ষ। তবে ১৯৯১ এর জনগণনা অনুযায়ী এদের সংখ্যা ছিল ১৪ লক্ষ।

২. ভাষা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি

বাংলাদেশে নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো জনসংখ্যাগতভাবে ক্ষুদ্র হলেও প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীর রয়েছে পৃথক পৃথক ভাষা ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশে নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়গুলো খুব দরিদ্র; এছাড়া রয়েছে  সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাদপদতা বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অন্যতম। চাকমা, মারমা, গারোসহ কয়েকটি অগ্রসর জাতিগোষ্ঠী ব্যতিত অধিকাংশ নৃগোষ্ঠীর ভাষার লেখ্যরূপ নেই। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে কোন গবেষণা তথ্য নেই। বাংলাদেশের গড় সাক্ষরতা হারের তুলনায় নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম।

১৯৯১ সালের জনগণনা জরিপ অনুযায়ী নৃগোষ্ঠীদের মধ্যে এই শিক্ষার হার ছিল মাত্র শতকরা ১৪ ভাগ। বিগত বছরগুলোতে এই পরিস্থিতির বিশেষ কোন উন্নতি হয়েছে বলে ধারনা করা হয় না। কারণ প্রাথমিক বা মৌলিক শিক্ষারক্ষেত্রে নৃগোষ্ঠী জনগণের পর্যাপ্ত অভিগম্যতা নেই (barriers to access)। চরম দারিদ্র্য, ঝরে পড়া (স্কুলের দূরত্ব, শিশুশ্রম/জুম চাষ), শিক্ষার মানগত সমস্যা, সাংস্কৃতিক বৈষম্য, কমিউনিটির সম্পৃক্ততার অভাব প্রভৃতি কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার খুবই কম। এ সকল বাধা পেরিয়ে যারা বিদ্যালয়ে আসে তাদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীতে ঝরে পড়ে। মাত্র ৭.৮ ভাগ শিশু ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা সমাপ্ত করে থাকে।

পার্বত্য এলাকায় নৃগোষ্ঠী শিশুদের শিক্ষার মাধ্যম হলো বাংলা। এটি তাদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম বড় বাধা বলে ধারণা করা হয়। শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক, শ্রেণীকে শিক্ষা প্রদানের ভাষা শিশুদের মাতৃভাষা থেকে ভিন্ন হওয়ায় শিক্ষাগ্রহণে শিশুর আগ্রহ সৃষ্টি হয় না এবং শিশু কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করতে পারেনা। বিশেষত: যারা অপক্ষাকৃত দরিদ্র এবং প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থী (first generation learners) তারা বিদ্যালয়ে এবং গৃহে উভয় ক্ষেত্রেই আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনা এবং সহসাই ঝরে পড়ে।

৩. গবেষণার প্রক্ষাপট

মাতৃভাষার মাধ্যমে নৃগোষ্ঠী শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমকে সফল করে তুলতে ইউনেস্কো এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ ১২টি দেশে নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে (anilingual/bilingual program) মৌলিক শিক্ষা কর্মসূচিতে সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করছে। সংস্থাটি মনে করে মাতৃভাষার মাধ্যমে মৌলিক শিক্ষা অর্জিত হলে পরবর্তীতে শিক্ষার্থীরা জাতীয় ভাষাও সহজে ও দ্রুতগতিতে অর্জন করতে সক্ষম হয়। এজন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে EFA এবং MDG লক্ষসমূহ অর্জনের সহায়ক হিসেবে ইউনেস্কো নৃগোষ্ঠী শিশুদের জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার Pilot Project  বাস্তবায়নে সহায়তা প্রদান করছে।

সার্বিকভাবে দেশের নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের মধ্যে মাতৃভাষায় মৌলিক শিক্ষা প্রসারে সার্বিক সহায়তা প্রদান করছে আরও একাধিক সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো brac, Save the Children (USA), Caritas সিপ্রাড, কৈননিয়া, গণস্বাস্থ্য প্রভৃতি কয়েকটি সংস্থা। কেমন করছে নৃগোষ্ঠী শিশুরা এই সকল শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে? এই সকল প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করেছে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন কর্তৃক বাস্তবায়িত এই গবেষণা

৪. গবেষণার উদ্দেশ্য

ক.     বাংলাদেশে মাতৃভাষা ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম ও নীতিসমূহের সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
খ.    নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে (initial level) শিক্ষার জন্যে মাতৃভাষা ব্যবহারের কার্যকারিতা পর্যালোচনা
গ.    মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে কমিউনিটির অংশগ্রহণ, শিক্ষা-শিখন পদ্ধতি, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদির কার্যকারিতা
ঘ.    প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে একটি মানসম্মত মাতৃভাষা ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্যে সুপারিশমালা প্রণয়ন

৫. গবেষণা পদ্ধতি

গবেষণার কাজে গুণবাচক (qualitative) এবং পরিমাণবাচক (quantitative) উভয়বিধ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে। গবেষণার উদ্দেশ্য (objectives) সামনে রেখে যে সকল সূত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

নৃগোষ্ঠী অভিভাবক/মা-বাবা, কমিউনিটি লিডার, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, শিক্ষা কর্মকর্তা (UEO/AUEO), নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী, আনুষ্ঠানিক (formal) ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা/শিক্ষক/ফ্যাসিলিটেটর, সংশ্লিষ্ট Key Informant, গবেষক ও ভাষাবিদ ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী শিশুদের মধ্যে শিখনযোগ্যতার পরীক্ষা (Competency test) গ্রহণ করা হয়েছে।

এ গবেষণা সমীক্ষায় তিন ধরনের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি জরিপের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে (ক) পার্বত্য অঞ্চলে মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (জাবারাং) (খ) পার্বত্য অঞ্চলে মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিচালিত অনানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা [কারিতাস], (গ) সমতলে (দেশের উত্তরাঞ্চলে) আশ্রয় (ASHRAI) পরিচালিত ওরাঁও সম্প্রদায়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচি। এ গবেষণায় তুলনামূলক আলোচনার জন্য Matching group হিসেবে গবেষণা করা হয় তিন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :

i)          GPS/RNGPS  (বাংলা মাধ্যম)
ii)     উপানুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা (brac, DAM ইত্যাদি কর্তৃক পরিচালিত বাংলা মাধ্যম)
iii)    উপানুষ্ঠানিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (DAM, পদক্ষেপ প্রভৃতি পরিচালিত)
আলোচ্য সার-সংক্ষেপ সমীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।

৬. গবেষণার ফলাফল

গবেষণায় উভয় এলাকার মোট ৪৩৭ জন শিশুর ওপর পরিচালিত এই জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, সকল নৃগোষ্ঠী শিশু প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় পড়ালেখা করছে তাদের তুলনায় মাতৃভাষায় পড়ালেখা করছে এমন শিশুরা সাধারণভাবে এগিয়ে আছে। বিশেষত: মাতৃভাষায় যারা পড়ালেখা করছে তাদের ক্ষেত্রে সৃজনশীল ক্ষমতার বিকাশ অধিক লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশুদের মধ্যে পরিচালিত competency test (বা শিখন যোগ্যতার পরীক্ষা)-য় মাতৃভাষায় যেসব নৃগোষ্ঠী শিশু পড়ালেখা করছে তারা তারা ভাষার ক্ষেত্রে অধিকতর সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছে। competency test-এর ফলাফলে লক্ষনীয় যে, গোড়ার দিকে মাতৃভাষায় শিক্ষার্থীরা খুবই ভালো করেছে (Pre-Primary I Grade-2) টেবিল-১।

Table-1: Average scores obtained in the test

 

Grades Type Mean score obtained
Rajshahi CHT
Pre-primary NFE-ML na 29.48
NFE-NL na 23.13
GPS/RNGPS na na
Grade 2 (Language) NFE-ML 21.90 19.32
NFE-NL 21.79 10.14
GPS/RNGPS 20.28 17.10
Grade 2 (Math) NFE-ML 22.75 20.42
NFE-NL 27.52 19.05
GPS/RNGPS 24.85 18.05
Grade3 (Environmental Science) NFE-ML 16.25 20.21
NFE-NL 19.35 17.41
GPS/RNGPS 23.05 22.15
Grade 5 (Language) NFE-ML 17.30 21.50
NFE-NL 20.75 18.60
GPS/RNGPS 18.80 21.89

                 Note: na = not available

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানের ফলে এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেছে যেমন:
ক.    কর্মসূচিতে কম্যুনিটির সক্রিয় অংশগ্রহণ;
খ.    গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষা উপকরণ উন্নয়ন যেখানে ভাষার লেখ্যরূপ নেই, সেখানে বিকল্প বর্ণমালা ব্যবহার; context সমূহকে more culturally contextual করে তোলা;
গ.    অতিদরিদ্র ও ঝরে পড়া শিশুদের অংশগ্রহণ; first generation learners-দের আধিক্য;
ঘ.    শ্রেণীকে শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ায় মাতৃভাষার সম্পূর্ণ ব্যবহার (facilitator প্রশিক্ষণ প্রদান)।

মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সপক্ষে নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সাধারণ জনগণ এবং শিক্ষার্থী শিশুদের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লক্ষ করা যায়। অভিভাবক/মা-বাবার মতে, তাদের শিশুরা মাতৃভাষায় পরিচালিত পড়ালেখার প্রতি পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। তারা বলেন শিশুরা কি পড়ছে তা তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন যা তাদের নিজেদের জন্যেও একটি সুখকর অভিজ্ঞতা। মাতৃভাষায় শিক্ষা সীমিত পরিসরে হলেও নৃগোষ্ঠী শিশুদের বিরাজমান মৌলিক শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত করতে শুরু করেছে বলে তারা মনে করেন। এছাড়া তারা বিশ্বাস করে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা একটি নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে যার মাধ্যমে তাদের শিশুরা আরও অধিক সংখ্যায় শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে। সর্বোপরি এই শিক্ষার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি যা তারা হারিয়ে ফেলতে বসেছিলেন সেই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি ভিত্তি তৈরি হবে।

গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, বাংলা ভাষায় পরিচালিত শিক্ষা সম্পর্কে অভিভাবকদের মতে, বিদ্যালয়গুলোতে শিশুরা ভাষাগত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়; নৃগোষ্ঠী শিশুরা বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক বা বাঙালি সহপাঠীদের সাথে কার্যকর সংযোগ (effective communication) গড়ে উঠেনা যা কাঙ্খিত শিখনফল সৃষ্টির পথে একটি বড় বাধা। এত করে শিশুরা বিদ্যালয়ে যাবার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। যে সকল শিশু বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করে থাকে তাদের মতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা না বুঝে পড়া মুখস্থ করে থাকে। এছাড়া কোন বিষয়ে স্বাধীনভাবে লিখতে পারার দক্ষতা খুব কম। শ্রেণীকে প্রদত্ত পাঠ বাংলা ভাষায় হওয়ায় তা অনুসরণ করতে তাদের সমস্যা হয়।

গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষায় কেবলমাত্র ঐ সকল শিশুই কিছুটা এগিয়ে যেতে পারে তাদের গৃহে সহায়তা করবার মত বাংলায় শিক্ষিত ভাই/বোন/বাবা/মা/ বা গৃহ শিক্ষক ইত্যাদি রয়েছে। বাংলা মাধ্যমে অধিকাংশ নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত ঝরে পড়ে যে অল্প সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে (১০ শতাংশের কম) তাদের মধ্যে সৃজনশীল দক্ষতার বিকাশ ঘটেনা।

গবেষণায় দেখা যায় শিশুদের জন্যে মাতৃভাষায় পরিচালিত শিক্ষা কেন্দ্রগুলো NFE বা উপানুষ্ঠানিক পদ্ধতিতে পরিচালিত। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ঐ সকল কেন্দ্রে পড়ালেখা শেষ করে সীমিত সংখ্যক শিক্ষার্থী বর্তমানে ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম শ্রেণীতে পড়ালেখা করছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতে তারা বাংলা মাধ্যমে যারা পড়ালেখা করে এসেছে তাদের তুলনায় খারাপ করছে না।

সরকারি উদ্যোগ

দেরিতে হলেও বাংলাদেশে যে সকল সরকারি দলিলে বা কর্মসূচিতে নৃগোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে সেগুলো হলো :

ক.    দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র, ২০০৫ (PRSP)
খ.    দ্বিতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি-II (PRSP-II)
গ.    জাতীয় শিক্ষানীতি (চূড়ান্ত খসড়া) ২০০৯

নৃগোষ্ঠী শিশুদের শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও সমস্যাসমূহ অতিক্রমের জন্যে PEDP-II-এর মাধ্যমে একটি Action Plan of Mainstreaming Tribal Children  (২০০৬) গ্রহণ করা হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় বলা হয়েছে এ দেশের নৃগোষ্ঠীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানোর কথা। প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ক ১৬নং কৌশলে বলা হয়েছে নৃগোষ্ঠী শিশুরা যাতে তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে পড়তে ও লিখতে পারে সেই লক্ষে নৃগোষ্ঠী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করতে হবে। এ কাজে নৃগোষ্ঠী সমাজের সক্রিয় সম্পক্তৃতা প্রয়োজন। নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জন্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা কেবলমাত্র মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা বোঝায় না। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:

ক)    সৃজনশীল শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন
খ)   Cultural Conservation and (Preservation, maintenance, development)
খ)    জাতীয় ও মূলধারার ভাষার সাথে bridging বা সেতুবন্ধন

৭. সুপারিশমালা

বর্তমান গবেষণার আলোকে নিম্নলিখিত সুপারিশগুলো করা যেতে পারে :
১.    নৃগোষ্ঠী শিশুদের শিক্ষার জন্যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার সূচনা হলে তা কাঙ্খিত শিখন ফল সৃষ্টিতে সক্ষম হবে;
২.    সৃজনশীল শিক্ষার বিকাশ এবং পরবর্তীতে জাতীয় ভাষার মাধ্যমে জীবন ও জীবিকাপযোগী শিক্ষার জন্যে শক্তিশালী bridging programme  সৃষ্টি করতে হবে;
৩.    মাতৃভাষাভিত্তিক সকল শিক্ষা কর্মসূচির জন্যে মানসম্মত material I facilitation তৈরি করতে হবে;
৪.    বিদ্যালয় সংখ্যা এবং নৃগোষ্ঠী শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রদানে সক্ষম (নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় হতে) শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে;
৫.    বিদ্যালয়ে মানসম্মত পরিবেশ সৃষ্টি, দরিদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের school feeding, পার্বত্য এলাকায় বিদ্যালয়ের সাথে বোর্ডিং হাউস স্থাপন করতে হবে;
৬.   ML কর্মসূচি সমূহে Monitoring/quality control-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে;
৭.    জাতীয় পর্যায়ে National Plan for Primary Education of Ethnic Minority Children বাস্তবায়নে NCTB কর্তৃক নৃগোষ্ঠী সমূহের ভাষায় পাঠ্যবই প্রবর্তন, প্রয়োজনীয় শিক্ষক, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে;
৮.    বিদ্যমান উপানুষ্ঠানিক ML ভিত্তিক কার্যক্রম ও আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয়সমূহের মধ্যে সংযোগ (Linkage) দৃঢ় করা প্রয়োজন রয়েছে।

৮. উপসংহার

সার্বিক পর্যালোচনার আলোকে বলা যায় নৃগোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। সরকারি নীতিমালা ও কার্যক্রম এখনও সীমিত ও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পক্ষান্তরে, উন্নয়ন সহযোগী এবং উন্নয়ন বাস্তবায়নকারীদের কর্মকাণ্ড নিরীক্ষামূলক স্তর (experimental phase) অতিক্রম করছে।

আরও গবেষণার মাধ্যমে এই সকল কার্যক্রমকে অধিকতর কার্যকর করার অবকাশ রয়েছে। তবে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সত্ত্বেও এই সকল কার্যক্রমের মাধ্যমে এই ধারণাই প্রমাণিত হচ্ছে যে, একজন নৃগোষ্ঠী শিশুর শিক্ষার সূচনা তার মাতৃভাষার মাধ্যমে হলেই সর্বোচ্চ কাঙ্খিত শিখনফল অর্জন সম্ভব। নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত উত্তরাধিকার সংরক্ষণের জন্যেও তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান জরুরি। তদুপরি নৃগোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার বিরাজমান সমস্যাগুলো আশু সমাধান করতে পারলে ২০১৫ সনের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি নিশ্চিত হবে।

Anup Kumar Kar      Coordinator, HR     Dhaka Ahsania Mission

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts