পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে-সিনেমায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ উপেক্ষিত!

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে আসা প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে, যাঁদের দুর্বিসহ জীবন দেখে যুক্তরাষ্ট্রের কবি অ্যালেন গিনসবার্গ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। সেইসময়ে কলকাতা শহরেরই একটি বাড়িতে চলেছে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সেই দিনগুলোর পরে কেটে গেছে ৪৫টা বছর.. কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে পাশে থাকার যে আবেগ ছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষের, তারপরের সাড়ে চার দশকে সেই আবেগ থেকে কি অনেকটা দূরে সরে গেছেন কলকাতার মানুষ? যে কারণে এতগুলো বছরেও পশ্চিমবঙ্গের সিনেমা বা সাহিত্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এখনও প্রায় অনুপস্থিত?

 

যে লড়াইয়ের অন্যতম স্তম্ভ থেকেছে যে ভাষাটা – সেই একই ভাষাতে যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন বা ছবি বানিয়ে থাকেন, সেই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্রকাররা কী করে নিস্পৃহ হয়ে পড়লেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে?

 

পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র বিশ্লেষক ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টডিজ বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বললেন : “১৯৭১ থেকে এই ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওপার বাংলায় গদ্য সাহিত্য, চলচ্চিত্র বা কবিতা – সব ক্ষেত্রেই ভাষাকে অবলম্বন করে একটা আত্মপরিচয় খোঁজার চেষ্টা চলেছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপরে ভিত্তি করে ১৯৪৭-এ যে দেশ ভাগ, সেটা যে ভুল, তার প্রমাণ ওঁরা পেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের সমস্যাটা হচ্ছে যে ৭১ থিতিয়ে যাওয়ার পরে এখানে সকলে যেমন দ্বিজাতি তত্ত্ব যে ভুল প্রমাণিত হয়েছে, সেটা মেনে নেন, কিন্তু এই জয়টাকে মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনীর জয় বলেই মনে করেন ।”

 

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলেন : ” পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যেহেতু একটা অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা, এখানে অনেকগুলো ভাষার মধ্যে একটা হল বাংলা, তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয়টাকে নিজেরা কখনই হয়তো উপলব্ধি করতে পারেন নি এদিকের মানুষ, কিন্তু নিঃসন্দেহে সমর্থন করেছে। যারা বয়সে খুব প্রবীণ, তাদের ক্ষেত্রে এটা নস্টালজিয়া, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও তরুণ প্রজন্মের কাছে তো সেই স্মৃতি নেই, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে নিজেদের রিলেট করতে পারে না।”

 

নামী প্রকাশক ও কলকাতা বই মেলার অন্যতম প্রধান সংগঠক ত্রিদিব চ্যাটার্জীও স্বীকার করলেন যে সত্যিই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এপারের বাংলা সাহিত্যে সেভাবে উঠে আসে নি।

 

ত্রিদিব চ্যাটার্জী বলেন :  “১৯৭১ আর তার ঠিক পরবর্তী সময়ে কিন্তু বেশ কিছু গল্প-উপন্যাস আমার মনে পড়ছে, যেগুলো মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েই লেখা হয়েছিল। প্রফুল্ল রায়, শঙ্কর এঁদের উপন্যাসগুলি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। এছাড়াও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সমরেশ মজুমদারের লেখায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে। কিন্তু নবীন প্রজন্মের যে লেখকরা, তাঁরা কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন বলে মনে করতে পারি না। আশির দশকের মধ্যভাগের পরে তো কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো কেউ লেখেনই নি ।”

 

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চিন্তা বা মননে হয়তো কোনও ফারাক নেই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের লেখকদের কাছে এই দুই দিকের সাঁকোটা জোড়া লাগে নি। দুর্ভাগ্যের হলেও এটা মানতে হবে। আসলে ৭১ পরবর্তী যে রাজনৈতিক ঘটনাগুলো বাংলাদেশে হয়েছে, মুজিব হত্যা, নতুন সামরিক প্রশাসন – সব মিলিয়ে যে একটা ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ পেরলো, বা তারপরেও অস্থিরতা – সব কিছু দেখে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে গেছেন।”

 

”তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি কিন্তু এখনও কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে নাড়া দেয়। কিন্তু ত্রিপুরা বা বরাকের মানুষের কাছে এখনও বাংলাদেশ নামটাই অন্যমাত্রা বহন করে, সেগুলো তাদের লেখাতেও বোঝা যায়।”

 

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা নিরুত্তাপ হয়ে যাওয়ার অন্য দুটি কারণের কথা বললেন তথ্যচিত্র নির্মাতা সৌমিত্র দস্তিদার।

 

soumitradasidar

 

সৌমিত্র দস্তিদার বলেন : “৭১-এ যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল, ঠিক সেই সময়েই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন চলছে। প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছেন, পুলিশ গুলি চালাচ্ছে, প্রায় প্রতিটা পাড়া থেকেই যুবকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ – একটা চূড়ান্ত অস্থির সময় ছিল সেটা। নিজের রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে যতটা আলোড়িত হয়েছিলেন লেখক- চলচ্চিত্র নির্মাতারা, সেই পরিবেশে তাঁরা আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশি হয়তো মাথা ঘামাতে পারেন নি। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তরফে যা সাহায্য সহায়তা করা হয়েছিল, তার কেন্দ্রে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু ঘটনাচক্রে নকশাল আন্দোলন বা তার পরের জরুরি অবস্থার কারণে বহু মানুষই – বিশেষত বুদ্ধিজীবিদের একটা বড় অংশ মিসেস গান্ধীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, সেজন্যও হয়তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এদিকের মানুষ কিছুটা নিরুত্তাপ থেকেছেন ।”

 

 

সাহিত্য পুরস্কার জয়ী লেখক অমর মিত্রও মানছেন যে তারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নিরুত্তাপই থেকেছেন এতগুলো বছর ধরে।

 

amarmitra

 

অমর মিত্র বলেন : “লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। সেখানকার সাহিত্যে যে প্রভাব মুক্তিযুদ্ধ ফেলেছে, সেটা যে আমাদের এদিকে পড়বে না, এটা স্বাভাবিক। মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব তো বাংলাদেশের সাহিত্যটাকে অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। কোনও ব্যক্তিবিশেষের লেখায় হয়তো মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব পড়ে থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে সেটা ঘটে নি।”

 

অমর মিত্র অবশ্য এত বছর পরে এসে সাতক্ষীরায় ফেলে আসা শিকড়ের টান অনুভব করছেন। এর আগে যদিও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সীমান্তে ওষুধ বয়ে নিয়ে যাওয়ার তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা থেকে একটা গল্প লিখেছিলেন, কিন্তু এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রীতিমতো রিসার্চ করে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন অতি সম্প্রতি।

 

“বয়স যতো বাড়ছে, ততই বোধহয় শিকড়ের টান অনুভব করছি,” বলেন অমর মিত্র।

 

সেই টান কেন অন্য সাহিত্যকার বা চলচ্চিত্রকারেরা অনুভব করেন না, কেন উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা নিয়ে তাদের গল্প-উপন্যাস বা কবিতা লেখার কথা বা সিনেমা তৈরির কথা মনে হয় না, সেটা জানতে যখন আরও বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম, তারা বলেই দিলেন এ বিষয়ে কোনও কথা বলবেন না তারা।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts