আশাপুরের ফিরোজার ‘মুক্তি’র শক্তি

এএইচএম নোমান []

গত ২৩ জুন ২০০৭ কালিয়াকৈর (গাজীপুর) স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বাজেট ক্লাব সভার আলোচনা শেষে একান্ত কাছাকাছি কথা বর্তায় লক্ষ্যহীন চেহারার ফিরোজার মধ্যে তুষের আগুনের মত জ্বালাতন কাজ করছে দেখলাম। সঙ্গে থাকা ওর মা বার বার বলছিল- ওর দুঃখের কথা শুনলে আপনার চোখেও পানি আসবে। ফিরোজা ২০০৫ সালে র্ডপ প্রবর্ত্তনকৃত মাতৃত্বকালীন ভাতাপ্রাপ্ত একশত নির্বাচিত মা’র অন্যতম এক জন। ফিরোজা, সে কিভাবে তার ভবিষ্যৎ দেখতে চায়, তার নিজ চিন্তা ভাবনা, যা ইচ্ছা, যে ভাবে মনে করে তা লিখে আমাকে পাঠাতে বলেছিলাম। দু’পৃষ্ঠার ভুল শুদ্ধ বানানের তার লিখা চিঠিটি আমার জন্য এক বিশাল উপলদ্ধিসহ জোগায় ভবিষ্যৎ পথ শক্তি। আমার লিখা বইতে প্রকাশিত ফিরোজার চিঠিকে গবেষক-লেখক শাওয়ালখাঁন প্রতিবুদ্বিজীবি ম্যাগাজিনে তাঁর মন্তব্যসহ যা উল্লেখ করেছেন তা থেকে কিয়দংশ তুলে দিলাম, শিরোনাম ছিল ‘সময়ের মানচিত্র : ইতিহাস যখন পাঠকের কাঠগড়ায়’।

 

‘‘…এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের জীবন বড়ই ক্ষণস্থায়ী। ঐ ক্ষণস্থায়ী জীবনের কত স্বপ্ন, কত আশাই না মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সাফল্যের পুষ্প পল্লবে মানুষ ভরে দিতে চায় তার জীবন। কারো স্বপ্ন জীবনে বাস্তবায়িত হয় আবার কারো কারো স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেয়ার জন্য দরকার একটি স্থির লক্ষ্য। লক্ষ্যই সাফল্য স্থাপন করে”। (আশাপুরের ফিরোজা : নারীর জ্বালা নারী জানে ১৫.০৭.২০০৭)।

feroja

অনানুষ্ঠানিক কিছু লেখাপড়া জানা আশাপুরের ফিরোজা এক হতভাগী মা। দীর্ঘ ৯ বছর পর যমুনা রেলসেতু লিংক প্রকল্পের দু’পাশে সৃজিত গাছের মূল্য বন্টন ও হস্তান্তর অনুষ্ঠানে কালিয়াকৈর উপজেলা হলে গত ০৪/০৯/২০১৬ তারিখে গেলে, সেখানে স্থানীয় সহকর্মী ‘দিশারী’র মতিউর রহমানকে দিয়ে ফিরোজাকে খবর দিলে সে উপস্থিত হয়। বলেছিলাম আমার জন্য আবার একটা লিখা আনতে। ইউএনও মোহাম্মদ সানোয়ার হোসেন’র অফিস কক্ষে দেখা হলে পাশে বসা ছোট্ট মেয়েটি বলে ‘মা, স্যারকে তোমার লিখা চিঠিটা দিবেনা? এ কথা বলে মেয়েটিই চিঠিটা দিল। মা পাশ থেকে বলল, ‘ওর জন্যই মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছি, এখন ও ক্লাশ ফোর এ পড়ে। তৃপ্ত বোধ করলাম। তার আনা ২নং চিঠি থেকে বিজয়ের মাসে পাঠকদের জন্য কিছু উদ্ধৃতি দিলাম …অনেক অভাবের মধ্যে দিয়েও আমি আমার দুইটি মেয়েকে লেখা পড়া শিখাইতেছি। রাত শেষ হবে কবে। ঘরেতে অভাব। পৃথিবীটা তাই মনে হয় বড় অসহায় জেনেছি। সত্যি হলো এক ধরনের বিশ্বাস যা বহুদিন পর মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম আমি। সে বিশ্বাসটি হলো, মানুষের ‘মুক্তি’র পথ জনগণের মাঝেই মিশে আছে। জনগণ বলতে সাধারণ খেটে খাওয়া, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে বোঝানো হয়। সেই জনগণের ভেতর থেকেই ‘মুক্তি’র সোপাণ বেড়িয়ে আসবে। …এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শ্রমজীবি ও মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের কারণে। যেখানে লক্ষ হাত আপনাদের মত মানুষেরা বাড়িয়ে দেন, সেখানে সৃষ্টির নতুন পথ হয় রচিত। যে মানুষ দুঃস্বপ্নের মধ্যেও দিন রাত কাজ করে, যারা শত বাঁধাকে উপেক্ষা করে মা-মাটির টানে দেশের হিতার্থে কাজে এগিয়ে আসে, তারাই প্রকৃত মানুষ। সেই শ্রমজীবি মেহনতি সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে গেলেই জীবনে প্রকৃত আনন্দ পাওয়া সম্ভব। আমি মনে করি এটাই ‘মুক্তি’র মৌল সত্য’’।…

 

এবারের বিজয়ের মাসের প্রথম সপ্তাহে গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ বিশ্ব সাহিত্য কেদ্রে ‘মা স্বপ্ন ফাউন্ডেশন’র উদ্যোগে ‘জায়াপতি’ সম্মাননা প্রাপ্ত অন্যতম ফিরোজা যা বলেন ‘র্ডপ প্রথম যখন ২০০৫ সালে বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে নিজস্ব উদ্যোগে মাসে ১০০ টাকা করে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান শুরু করে। আমি দ্বিতীয় গর্ভধারণের বেলায় সেই মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছি। ভাতার টাকা দিয়ে আমি ও আমার শিশু পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি। যে কারণে আমার দুটি মেয়ে সন্তান পুষ্টিসম্পন্ন অবস্থায় আছে। আমি গর্ভকালীন অবস্থায় কোন পুষ্টিকর খাবার খেতে পেতাম না যদি আমাকে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান না করত। আমার পরিবার অতি দরিদ্র। নিজের কোন ঘর বাড়ি নেই, কোন সম্পদ ও পুঁজি নেই। আমি ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ প্রকল্পের সহযোগিতা পাইনি, পেলে নিশ্চয়ই পারিবারিক অবস্থার উন্নতি করতে পারতাম। সরকারের কাছে আকুল আবেদন আমাকে ও আমাদের মত গরীব মা’দের জন্য ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ সারা দেশে চালু করুন। আমি জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। প্রথম সন্তান ৯ম শ্রেণীতে এবং দ্বিতীয় সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ছে। আমার দুটি গাভী রয়েছে যা অন্যের কাছ থেকে বর্গা নিয়ে লালন পালন করছি। আমার স্বামী একজন কৃষক, নিজের জমি নেই, অন্যের জমিতে কাজ করে। দুজন মিলে মাসে গড়ে প্রায় ৮০০০(আট হাজার) টাকা আয় করি। তা থেকে সংসার পরিচালনা করি এবং মেয়ে দুটির লেখা পড়ার পিছনে খরচ করি’।

 

জায়াপতি সম্মাননা অনুষ্ঠানে ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ মালিকানা প্রাপ্ত টুঙ্গীপাড়ার রাবেয়া বেগম এবং কালিগঞ্জের (গাজীপুর) মা- সংসদ’র স্পিকার অর্পিতা রাণী সরকারসহ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় যৌথ অবদানের জন্য ফিরোজাসহ ৭ জন এই মিছিলে ছিলেন।

 

ফিরোজার স্বপ্নের মিছিলের আর এক জন রাবেয়া বেগম, ‘আমি একজন মাতৃত্বকালীনভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ প্রাপ্ত মা। আমার প্রথম গর্ভধারণের বেলায় মাতৃত্বকালীন ভাতা পেয়েছি। আমি মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ীর পাশের বাসিন্দা, টুঙ্গিপাড়া থেকে এসেছি। মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ দেয়ার জন্য আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনাকে এবং র্ডপ এর প্রধান জনাব এএইচএম নোমান স্যারকে ধন্যবাদ জানাই। আমি মাসে ৩৫০ টাকা করে মোট ২৪ মাস এ ভাতা পেয়েছি। এই ভাতার টাকা দিয়ে পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি বলে আমি পুষ্টিসম্পন্ন সন্তান জন্ম দিতে পেরেছি। আমি আগে অনেক গরীব ছিলাম। আমার থাকার কোন ঘর ছিল না, কোন সম্পদ ও পুঁজি ছিল না। এ অবস্থায় যখন আমি স্বপ্ন প্যাকেজ থেকে একটি ঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত একটি ল্যাট্রিন ও একটি ভ্যান পেলাম, তখন আমার কাছে স্বপ্ন ঘরটি এবং সবকিছু স্বপ্নের মতই লেগেছে। আমরা এখন টিনের ঘরে বসবাস করি। বর্তমানে আমার ১টি মেয়ে সন্তান। যার বয়স ৪ বছর। আমি জন্মনিয়ন্ত্রণের অস্থায়ী পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। সরকার আমাকে সহায়তা দিয়েছে আমি সরকারকে সহযোগিতা করব- পরিবার ছোট রাখব। আমার স্বামী স্বপ্নের দেয়া ভ্যান চালায়। তাতে যা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই ও কিছু সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করি। আমি গরু পালন করি ও সারা বছর শাকসব্জি আবাদ করি। দুজন মিলে সংসারটাকে সুন্দর ভাবে পরিচালনা করি। এখন আমরা বেশ সুখে আছি। আমার সন্তানকে শিক্ষিত করতে চাই। সরকারের কাছে আমার চাওয়া, আমার মত সারা বাংলাদেশের সকল গরীব গর্ভবতী মা যেন মাতৃত্বকালীন ভাতা ও স্বপ্ন প্যাকেজ পায়’।

 

অর্পিতা রানী সরকার বলেন, ভাতা দেয়ার জন্য আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। ভাতার টাকা দিয়ে আমি ও আমার সন্তান পুষ্টিকর খাবার খেয়েছি। যে কারণে আমি এবং আমার সন্তান ভাল আছি। আমি একটি ঘর, একটি স্বাস্থ্য সম্মত ল্যাট্রিন, একটি গরু সম্পদ পেয়েছি। একটি গরু থেকে আমার তিনটি গরু হয়েছে। তার মধ্যে দুটি আবার কিছু দিনের মধ্যে বাচ্চা দেবে। গরুর দুধ নিজেরা খাই ও বিক্রি করে সংসার চালাই এবং কিছু সঞ্চয় করি। আমি ১০টি বনজ ও ফলজ গাছ লাগিয়ে যতœ করে বড় করছি। আমার প্রথম বাচ্চার বেলায় ভাতা পেয়েছি সে এখন ২য় শ্রেণিতে পড়ে। বর্তমানে আমরা অনেক ভাল আছি। আমি চাই সারা দেশের গরীব গর্ভবতী মায়েরা যেন আমার মত ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ ও ‘স্বপ্ন প্যাকেজ’ পায়।

 

প্রধান অতিথি এইচটি ইমাম বিজয় দিবসের পটভূমির দীর্ঘ ধারাবাহিকতা এনে ‘মুক্তি’র পথ ও পাথেয় হিসেবে ‘কানেকটিং দ্যা ডিসকানেকট’ এর এই বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠানকে এটাই বাংলাদেশ বলে অভিহিত করেন। তিনি, আরো বলেন সংসারে স্বামী-স্ত্রীর বোঝাপড়া ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার মধ্য দিয়ে একটি সুন্দর পারিবারিক কাঠামো গড়ে ওঠে, সেই পারিবারিক কাঠামো সমাজ ও দেশগঠনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে জায়াপতিদের সম্মাননা স্মারক তুলে দিয়ে সরকারের স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এক গভীরতম শক্তি।

 

সর্বশেষ গত ১০ ডিসেম্বর ২০১৬ আমার সহকর্মী আব্দুল মালেকের সঙ্গে তার জীবন রচনা নিয়ে কালিয়াকৈর নার্সারী ঘরে এবার ফিরোজা তার নিজ খেকেই আমার কাছে তৃতীয় পত্রটি লিখে। এ চিঠিকে ভীত ধরেই আমার লিখার শিরোনাম ‘ফিরোজার মুক্তি’র শক্তি কথা। আমার উপলদ্ধির তৃষ্ণার ভাগীদার ফিরোজা এ চিঠিতে যা লিখেছে ‘মনের দুঃখ মনে লইয়া, ঘুড়ি বনে বনে। বৃক্ষের কাছে কইলে দুঃখ, বৃক্ষ যায় ঝড়ে। নদীর কাছে কইলে দুঃখ, জলে যায় ভেসে। দুঃখ বলব কার কাছে। বাড়ির শোভা বাগ বাগিচা, নারীর শোভা স্বামী। গাছের শোভা উঁচু ডালা, মাছের শোভা পানি। সরকারের শোভা জনগণ। আমরা জনগণ যদি এক থাকি তা হলে এই সুন্দর বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করতে পারি। যদি সরকার থাকে পাশে। এস সবাই শপথ করি। বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করি। আমাদের যার যতটুকু জমি আছে সেই জায়গায় বৃক্ষ রোপন করি। আজকে শিশু যেমন আগামী দিনের ভবিষ্যত, তেমনি গাছও আমাদের জীবনে ভবিষ্যত। গাছ থেকে আমরা অক্সিজেন পাই। একটি গাছ মানুষের অনেক উপকার করে। একটি ভাল ফলের গাছ কিন্তু একটি সংসারে চাহিদা মিটাইতে পারে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দেশের জন্য লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছেন এবং বাংলা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছেন। তাহলে আমরা সন্তান হয়ে, আমরা কেন বাংলাদেশকে অভাব ‘মুক্ত’ করতে পারিনা ? কষ্ট মানুষকে পরিবর্তন করে, কষ্ট মানুষকে শক্তিশালী করে। জয় বঙ্গবন্ধু জয় শেখ হাসিনা। ইতি, ফিরোজা, স্বামী: মজনু মিয়া, গ্রামঃ আশাপুর, ইউনিয়নঃ তালজোড়া, পোঃ নৈহাটি বাজার, থানাঃ কালিয়াকৈর, জেলাঃ গাজীপুর।

প্রিয় পাঠক বিজয়ের এ মাসে ফিরোজার ‘মুক্তি’র এই প্রশ্নবোধক আহবানের উত্তর এসডিজি’র ১৭ এজেন্ডাকে, উন্নয়নের তলরেখা ‘মা’ কেন্দ্রীক ‘একের ভেতর সতের’তে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আবাসন, কর্মসংস্থান, পরিবেশ, সঞ্চয় ইত্যাদি চাহিদা সম্বলিত স্বপ্ন প্যাকেজ বাস্তবায়ন করে দুনিয়াকে দারিদ্র্য বিমোচনের মুক্তির শক্তির কথা শুনাতে পারলেই বিজয়ের মুক্তির সাক্ষাৎ মিলবে।
এএইচএম নোমান, প্রতিষ্ঠাতা ‘ডরপ’ এবং গুসি আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
ই-মেইল: nouman@dorpbd.org

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts