ভূতের বাগান বাড়ি ॥ মনোজিত্‍কুমার দাস

রহস্য গল্প / /

গ্রামের নাম আলালপুর । বায়ান্ন ঘর জোতদার আর জমিদারের বসত ।বড় বড় দালান কোটায় জমিদারদের বসত । পাইক পেয়াদা , বরকন্দাজ , ষোল বেহারা পাল্কি , গায়ক বাদক কী নেই গ্রামটাতে । এ গ্রামের এক জমিদারের নাম লোহারাম মিত্তির ।

লোকে বলে , ভূতের রাজা । ভূতেরা তার কথায় উঠবস করে । মিত্তির মশাইয়ের ষোল বেহারার পাল্কি বাহক ষোল ভূত । তার লাঠিয়ালবাহিনী সবাই ভূত । এমনকি গায়ক বাদকরাও সব ভূত ।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা গড়াই নদীতে লোহারাম মিত্তির নাইতে আসেন ষোল ভূতের কাঁধে চড়ে পাল্কিতে ।

পাশের গ্রামের মিতিন বকসীর সাথে লোহারাম মিত্তিরের গলায় গলায় ভাব , যাকে বলে বন্ধুত্ব । অন্যদিকে , নিজের গ্রামের শীতল জমিদারের সাথে লোহারামে লাঠালাঠির সম্পর্ক । বন্ধুত্ব আর শত্রুতা দুটোই সমান তালে চালিয়ে যায় লোহারাম বাবু বেশ জোরেসোরেই পরস্পরের সাথে ।

শীতল বাবু বলে বেড়াতে থাকেন ,”লোহা ভূত পোশে , আর আমি পুশবো সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে ভূত । ভূতেদের রাজত্বে ওদের নাম পেতনী , নামটা শুনতে ভাল শোনায় না ,তাই আমি ওদের নাম রাখবো ভূতনী । ” এখানে বলে রাখা ভাল লোহা আর শীতল পরস্পর ভায়রা ভাই ।

শীতল তার বড় ভায়রা লোহাবাবুর নামে আজেবাজে কথা বলে বেড়ালেও সামনে কিছু বলতে সাহস করে না , কারণ রাতবিরেতে কখন না জানি লোহাবাবুর ভূতেরা ঘাড়টি মটকে দেয় এই ভয়ে ।

মিতিনবাবুর পদ্মার অঢেল জমি , বর্ষায় জমির সীমানা ঠিক থাকে না , জমিতে পলি পড়ে সব একাকার হয়ে যায় । চোত মাসে চরের দখল নিতে গিয়ে লাঠেলেঠি হয় । লোহাবাবুর ভূত বাহিনীকে আনার পর মিতিনবাবুকে আর হার স্বীকার করতে হয়নি । তাই লোহারাম বাবুর সাথে মিতিনবাবু দহরম মহরম অন্য রকমের ।

শীতলবাবু হিসেব মিলাতে পারেন না , মিতিনবাবু কীভাবে চরের দখল নেন , তবে কি তার ভায়রা ভাই লোহাবাবুর ভূতবাহিনী কাইজাতে .., । তিনি আর ভাবতে পারেন না । লোহারামবাবুর মানসম্মান আর প্রতিপত্তি দেখে শীতল বাবুর হিংসে হয় ।

মেয়ে ভূত পোষার সখ শীতলবাবুর মন থেকে উবে যায় তার গিন্নির মুখ ঝামটায় । গিন্নি সোয়ামীকে বলে , জামাইবাবুর সঙ্গে পাল্লা দিও না । তল্লাটে কে না জানে লোহারাম মিত্তির ভূতের রাজা , কার সাথে কার তুলনা ! তুমি কয়েকদিন ধরে ভূতনী না কী একটার নাম করছিলে ,সে কথা জামাইবাবু জানতে পারলে তিনি তোমার আগেই তার ভূতগুলোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে উঠে পরে লাগবেন । দিদি আর জামাই বাবু নাকি গত পরশু পেতনী তলা গিয়েছিলেন ভূতেদের জন্যে মেয়ে দেখতে । কিন্তু পথে একটা বিপত্তি নাকি ঘটেছে ।

বাড়ি থেকে বের হয়ে তেতুল ছাড়িয়ে একটু এগোতেই শীতলবাবুর নায়েব রামবাবুকে দেখতে পেরে ভূতগুলো পাল্কি ফেলে ভো দৌড় । লোহারামবাবু বুঝে উঠতে পারেন না তার ভূতগুলো ওই ভাবে পালাল কেন ? তার গিন্নি বললেন ,” তোমার ভূতেরা রাম নাম শুনলেই আঁতকে উঠে , আর আজ তারা তাদের চোখের সামনে রামবাবুকে জলজ্যান্ত দেখে ভয়ে পালিয়েছ ।”

লোহারামবাবু একটু পরেই বুঝলেন , গিন্নির কথাই ঠিক । রামবাবু চলে যেতেই ভূতগুলো এক পায়ে দুই পায়ে এসে হাজির হলো ।

গিন্নি বললেন , “আমাদের শীতলকে ঘাটিয়ে কাজ নেই । চল এখন ফিরে যাই আমাদের বাগান বাড়িতে । ” গিন্নির কথায় লোহারামবাবু রাজি হয়ে ভূতগুলোকে আদেশ করলেন , “পাল্কি ফেরাও , বাগান বাড়ি চলো ।” বাবুর কথা শুনে ভূতগুলো মনে মনে রেগে গেল । তাদের একজন বিড়বিড় করে বলল ,”যাচ্ছিলাম একটা শুভ কাজে , এখন সব ভেস্তে গেল । মানুষের পাল্লায় পড়ে কত কী না করতে হবে ।”

পালের গোদা ভূতটা পাল্কি দুটোর আগে আগে চলছিল । সে বলল , পা চালিয়ে চল তো দেখি , বাগান বাড়িতে পৌঁছে আমেজ করে মৌজ করা যাবে ।”

পালের গোদার কথা না শুনে ভূতদের উপায় নেই । তারা ভাবল । একজন তো ফিসফিসিয়ে বলেই উঠল , আমাগের পালে গোদা গ্যাঘোটার জন্যি ব্যাগার খাটতি হচ্ছেরে তোদের ।”

ভূতটার কথা শুনে আর একটা ভূত বললো , “বাগান বাড়িটাও দেখে আসা যাবেনে , বাগান বাড়ির পাশের বাগান বাড়ির পালের তেঁতুল বাগানের ভূতানীগুলোকেও দেখে আসা যাবে । ”

“পেতনী আবার কবে থেকে ভূতানী হলোরে , পংপং ।” খটমট নামের শিক্ষিত ভূতটা বলে উঠল । খটখট কলকাতায় থাকা ভূত ,ও কত কিছু জানে । বাগান বাড়িতে পৌছে ভূতগুলো হাফ ছেড়ে বাঁচল ।

পাল্কি থেকে নেমে লোহারাম বাবু বাগান বাড়ির দিকে তাকাতেই চক্ষু চড়ক গাছ । বাগান বাড়ির কী শ্রীরে ! তিনি মনে মনে ভাবলেন , এতো দেখছি ভূতের বাগান বাড়ি ! কে বলবে মানুষের বাগান বাড়ি । না জানি এমনটা কে করেছে । শীতলই কী আমার বাগান বাড়িটা কব্জা করে নিয়েছে ?

লোহারামবাবু মনের কথা মনে আছে এমন সময় বাগান বাড়ির ভেতর থেকে দলে দলে কিম্ভূতকিমাকার চেহারার কারা যেন বেরিয়ে আসছে । বাগান বাড়ির গেটে চোখ পড়তেই লোহারাম বাবুর চোখ ছানাবড়া । “তাহলে কি আমার বাগান বাড়ি …..” কথা   শেষ করার আগেই লোহারামবাবু ভিমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে গোঙাতে লাগলেন । গিন্নি তাড়াতাড়ি তার শাড়ির আচল দিয়ে বাতাস করতে লাগলেন । চোখেমুখে জলের ছিটা দেওয়ার দরকার ,কিন্তু পাল্কির বেহারাগুলো কোথায় গেল ।

তিনি বাগান বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখন ,গেটের সামনে বড় একটা সাইন বোর্ড । তাতে লেখা “ভূতের বাগান বাড়ি !” তিনি ভাবলেন , এনিয়ে চিন্তা করার সময় এটা নয় । লোহারামবাবু চোখ খুলে গিন্নিকে বললেন , “গিন্নি ভয়ের কোন কারণ নেই , আমার ঘোর কেটে গেছে । ওরা কোথায় গেল ? চল এখন বাগান বাড়িতে যাই ।”

স্বামীর কথা শুনে গিন্নি ভাবলেন , আসলে তার ঘোর কাটেনি । ঘোর কাটলে এমন কথা বলবেন কেন ! তার মনে হল তার ছোট ভগ্নিপতি শীতলের মতো কে যেন এদিকেই আসছে । শীতলই তো ! এ সময় শীতল কেন এখানে ।

শীতল এগিয়ে এসে তার দিদির দিকে মুচকি হেসে বললেন ,” আপনারা এখানে এ অবস্থায় কেন !” শীতলের কথার কি জবাব দেবে ভেবে পেলেন না । দিদির মুখ থেকে কোন জবাব না পেয়ে শীতলবাবু বললেন , “আপনাদের বাগান বাড়ি কি ভূতদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন , সাইন বোর্ড দেখছি , ভূতের বাগান বাড়ি !”

এবার ও তিনি কোন জবাব দিলেন না । তিনি মনে মনে ভাবলেন , তবে কি তাদের বাগান বাড়ি সত্যি সত্যি ভূতের বাগান বাড়ি হয়ে গেছে ।#

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts