কবিতা শুধুই দীর্ঘশ্বাস নয়,আকাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের বীজমন্ত্রও বটে! হৃদয়ের গোপন কন্দরে একটুখানিক রিনিঝিনি ব্যথা, আনন্দময় শিহরন।
সত্তর দশকের কবি নির্মল চক্রবর্তীর কবিতায় আছে মানবমনের সূক্ষ্ম নিরল অন্তর্বেদনা, মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েন, নিরন্ন দুঃখী মানুষের জীবনসংগ্রাম, হাজারো হতাশা গ্লানির মধ্যেও ইতিবাচকতার ইঙ্গিত। আছে বিভেদ বৈষম্যহীন সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণের প্রবল আকুতি, তার জন্যে অন্তহীন লড়াইয়ের তাগিদ ও অন্তর্প্রেরণা।
রক্তভেজা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে সত্তর দশকে সম্মিলিত যে কাব্যপ্রয়াস নতুন গতিবেগ,স্বপ্নোচ্ছ্বাসের ধারা তৈরি করেছিল, সেই স্বপ্নভঙ্গ হতে বিশেষ দেরি হয়নি। অস্থিরতায় টালমাটাল ওই কালকে গভীর আবেগে, শিল্পসুষমায় মণ্ডিত করে নির্মল চক্রবর্তী তার কবিতায় এঁকেছেন সময়ের ছবি। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিষাদভারাতুর ভাঙন, আশাবাদের খানিক ঝলকানিও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের পাশবিকতা, লোলুপ রক্ততৃষ্ণার বিশ্বস্ত চিত্র তিনি গভীর অভিনিবেশে অঙ্কন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের সেই খণ্ডচিত্র আমরা তার কবিতাপুঞ্জে পাই, সেই গৌরব সেই অপমান নির্যাতন নিপীড়ন স্মৃতিমেদুরতায় আপন বৈশিষ্ট্যে ঝলসে ওঠে পাঠকের মনোমুকুরে।
সমাজবিপ্লব কতদূরে? আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছুতে আর কত দেরি, অপেক্ষার সুদীর্ঘ পালার অবসান কবে? এই আর্তি কবিকে দোলায়িত করে, তার হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হয় অনাগত সুসময়ের শঙ্খধ্বনি- ‘দূরত্ব কত কমরেড?’ শিরোনামের কবিতায়-
আকাশে ভয়ার্ত শব্দ, বিজলি চমকানোর সাথে সাথে
আবারো দু’কদম হাঁটা
তারপর লোকালয়, বনবাদুড়ের অট্টহাসি
তবুও তোমাকে ঘিরে এগিয়ে যাওয়া
খোয়াই নদী, আসামবস্তি, ঘনসবুজ চা বাগান পেরিয়ে
নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতেই মনে হলো
বিপদসঙ্কুল পথে এগুচ্ছি আমরা,
অতঃপর চলে যাওয়া।
হ্যারিকেনের নিভু নিভু আলো এগিয়ে আসছে
গতি সংকেত বেজে উঠলো
চলে গেলাম নিরাপদ দূরত্বে
এইভাবে বৃষ্টিভেজা গভীর রাত্রিতেও
সংগ্রামমুখর মানুষের প্রতিচ্ছবি নিয়ে
কাক্সিক্ষত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
(কাব্যগ্রন্থ : ‘কোরাল দ্বীপের সন্ধ্যা পৃ ৫১)
সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণির ভুখা নাঙ্গা মানুষের দিনানুদৈনিক দুঃখগাথা, করুণ মানবেতর জীবনযাপনের ছবি তিনি নম্র কিন্তু দৃঢ় ও দরদি কলমে ফুটিয়ে তোলেন। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষজনের বঞ্চনা লাঞ্ছনা,স্বপ্নভঙ্গ, আবহমান কাল ধরে তাদের ওপর চলে আসা শোষণ-বৈষম্য তিনি খুব কাছে থেকে নিবিড় নিষ্ঠায় অবলোকন করেন, এই অবিচার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্পন্দিত হয় তার কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। চা বাগানের খেটে খাওয়া মান্দ্রু মুণ্ডার বাবা শহীদ হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আজও অব্দি মেলেনি তার চরম আত্মোৎসর্গের স্বীকৃতি। সেই হতাশ্বাস ও বিষন্নতা নির্মল চক্রবর্তীর কবিতার চরণে চরণে হাহাকার করে ওঠে।
ধামাই চা বাগানের তামাটে শ্রমিক
বুকভরা তার দীর্ঘশ্বাস
শ্রমের মূল্য নেই
শহীদী জীবনের স্বীকৃতিও নেই
শুধু দিন গোনে, স্বপ্ন দেখে, হাজারো স্বপ্ন,
স্বাধীনতার স্বপ্ন
সব যেন ধুলায় লুণ্ঠিত আজ।
(মান্দ্রু মুণ্ডার জীবনসংগ্রাম, কোরাল দ্বীপের সন্ধ্যা,পৃ ৫৭)
স্বাপ্নিক ও প্রতিবাদী এই কবির মানসজগৎ শুধু তার মাতৃভূমিতেই সীমিত নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের চলমান ঘটনাপুঞ্জ, ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি, বিশ্বমানবের হাল অবস্থাকে ঘিরে তার চিন্তার প্রতিফলন, মননের প্রসার দেখতে পাই আমরা। বৈশ্বিক বোধে তিনি তাড়িত, মানবতার লাঞ্ছনায় তার আত্মা পীড়িত, মর্মাহত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন, তেমনি ভিনদেশেও ব্যাপক ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় তিনি ঋদ্ধ, এতে পুষ্টি ও অন্য মাত্রিকতা পেয়েছে তার কবিতাশরীর। রক্তাক্ত ফিলিস্তিনের লড়াকু মানুষের সঙ্গে তিনি সহজাত আবেগ ও অঙ্গীকারে একাত্ম। শব্দবাণে তিনি ঘায়েল করতে চান প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্রাজ্যবাদী চক্রকে। অন্যায় অসম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ঘৃণার স্ফুরণ ঘটে তার কবিতায়-
বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বর্বরতম দেশের প্রধানমন্ত্রী
তাকে জানিয়ে দিতে হবে এ পৃথিবী
তোমাদের রাক্ষুসী থাবার জন্যে নয়
চারিদিকে তোমাদের যুদ্ধাপরাধের সুস্পষ্ট প্রমাণ।
আরব লীগ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থাকে জানিয়ে দাও
নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অসহায় মানুষকে বাঁচাও
ঘুমন্ত বিশ্ববিবেককে জাগিয়ে তোলো।
(রক্তে ভেজা ফিলিস্তিন, নিরুপায় ভেসে রই, পৃ ৪০)
সমাজপ্রগতির স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বারবার ফিরে আসে এই কবির রচনাগুচ্ছে। সেই ইচ্ছা, বিশ্বাস ও আস্থার আলোয় একটি সুন্দর সুঠাম সমাজব্যবস্থার অবয়ব গঠনের চেষ্টা আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। কিন্তু সেই স্বপ্ন ফলবতী হতে পারে না। বাস্তব ও প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধ আক্রোশ ও থাবার কাছে পরাস্ত পর্যুদস্ত হয় বারবার। কিন্তু বিপ্লবের জন্যে প্রবল তৃষ্ণা কখনো মরে না, বরং দীর্ঘায়িত ও স্থায়ী রূপ লাভ করতে থাকে। কবির সাফল্য সেখানে, যেখানে তিনি আশাকে জিইয়ে রাখতে পারেন। স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারেন। ‘জমে আছে কত মেঘ’ কাব্যগ্রন্থের ‘গুলিবিদ্ধ স্বপ্ন’ কবিতায় সেই আরাধ্য বিপ্লবের আপাতমৃত্যু আমাদের স্তব্ধ করে দেয় বটে- তবে একইসঙ্গে নতুন পথের দিশাও দেয়, চিনিয়ে দেয় গন্তব্যে পৌঁছুবার পথ, নতুন উদ্যম উজ্জীবন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। কবি এই কবিতায় বলেছেন-
যুবক গুলিবিদ্ধ
যুবকের পরিচয় নেই
সৌম্য মূর্তির যুবকটি এক সময়
ভালো গাইতো, ভালো খেলতো
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যুবকটি
ভর্তি হলো, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল
শোষকের হাত ভেঙে দেবে
সমাজকে বদলে দেবে
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যুবক চলে যায়
স্বপ্নের রাজ্যে।
মাকে, প্রিয়তমাকে লেখে শেষ চিঠি
কবে ফিরবে জানা নেই,
যুবক ক্ষেতেখামারে, শিল্পনগরীতে
ধোঁয়াটে অন্ধকারে কষ্টের রাত কাটায়
শ্রমজীবী মানুষ হয়ে যায় বন্ধু
বিপ্লব এগিয়ে যায়,শঙ্কিত শোষকেরা।
এক সময় নিরুদ্দেশ যুবক
পত্রিকার পাতা খুলে জানা যায়
বেওয়ারিশ একটি লাশ।
ফারাক্কা বাঁধের অভিসম্পাতে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুময়তা বিস্তৃত হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের সেই বেদনাছবি আমরা পাই ‘ফারাক্কা: ধাবমান দুঃখের নাম’ কবিতায়-
নতুন যৌবনা ফারাক্কাকে ঘিরে
এক নবচেতনা উৎকণ্ঠিত হয়
সেই উদ্বেগ আগুন হয়ে জ্বলে দাউদাউ
পুড়ে যায় ভাটি বাংলার মাইল মাইল শস্যক্ষেত
মরুভূমির থাবা কেবলই বিস্তৃত হতে থাকে।
৫ নবেম্বর ২০১৭ ছিল কবি নির্মল চক্রবর্তীর ৬৩তম জন্মদিন। বিপ্লবের দ্রষ্টা ও রূপকার মিতভাষী এই কবিকে জন্মদিনের শুভকামনা।