সাইরেন ও শিস
সাইরেন বাজিয়ে চলে গেলো অগ্নিনির্বাপক গাড়ি।একটা
লাল পতাকা উড়িয়ে বৃষ্টিও এলো হঠাৎ করেই,এই শহরে।
মানুষজন অনেক আগেই হয়েছে লাপাত্তা। কেউ শরণার্থী আর
কেউ ফেরারি হয়ে মুছে দিতে সকল বৃষ্টিদাগ,চলে গেছে অন্য
কোথাও। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। নির্বাক। শিস দিয়ে যাওয়া
দোয়েলটাও লিখে রাখছে শব্দাংক। তবে কী সে’ও খুব হিসেবি
আজ ! ভীষণ বর্ষণবিকেলে!অথচ আমরা ভিজছি না দুজনেই,
দেখে নিচ্ছি পাঁজরের তাপ টাঙানো আকাশটা খুলে।
সূর্যের পরিণত ঘর
একটি রক্তজবা হাতে নিয়ে মা বললেন, আজ বৃষ্টি হবে। ভিজে যাবে
সবটুকু সবুজ জমিন। ঘেরুয়া নদীর জল থেকে রক্তবাষ্প উড়ে দেবে
জানান, এই মাটিতে আততায়ী রাত নেমেছিল। হায়েনা পিশাচদের
উল্লাস কাঁপিয়েছিল এই আকাশ। সূর্যের পরিণত ঘর। মানুষের বিত্ত
বিবর। আর লুকিয়ে থাকার সাঁকো খুঁজে শরণার্থী তরুণ-তরুণী
গিয়েছিল উত্তরের বাঁকে। অগ্রজ পূর্বসূরীর হাতের লাঠি গর্জে উঠেছিল
‘থামো ঝড়, থামো বজ্র’ এমন আওয়াজে।
সেই প্রভাতে আমি ছিলাম মায়ের বাম হাত ধরা অবুঝ বালক। বালিকা
বোনটি কেঁদেছিল,’বাবা ,বাবা ‘-বলে।
বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। একটি গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে উড়ে গিয়েছিল
তার ডান হাত। তাই নিজ ডানহাতটিকে ভয়ে লুকিয়ে রাখতেন
আমার মা। আর বলতেন, দেখিস- আমার হাতটা যেন কেউ না দেখে।
তার ভয় ছিল খুব। বাবার হারানো ডানহাতটিকে তিনি মনে করতেন
নিজের হাত। বাবার চোখগুলোকে মনে করতেন নিজের চোখ।
সেই প্রভাতে আমার মায়ের নিজস্ব কোনো দৃষ্টি ছিল না। বৃষ্টি আসবে বলে
সকল মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টি দিয়ে তিনি তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকে।
আর বলেছিলেন, বৃষ্টি আসুক। তবু মুছে যাবে না এই বাংলা থেকে
থোকা থোকা রক্তগোলাপের দাগ।
কবিতাটি একাত্তর পরবর্তী
যে তুমি জানতে চাওনি, আমি কি কবিতা লিখি
অথবা আমার চোখে কি পড়ে গেছে ছানি,
ভুলে গেছি অশ্রুপাত এবং পিতৃহারার কাহিনি-
কিংবা অর্ধেক অন্ধ হয়ে বেঁচে আছি কী না
কেঁদে উঠি কি! দেখলে শাপলা ফুল কিংবা একটি সবুজ পাখি
যে তুমি জানতে চাওনি, আজীবন কেমন বিষাদ
আমাকে হরণ করেছে, পৌষের দুপুরে
কেন কেউ বিজয়ের স্মৃতিগল্প বললেই,
আমি আসি সরে,
একাকি-
আর লিখি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, শোকের প্রবাদ
অনেক কিছুই তুমি জানতে চাইবে না জানি
তবু একাত্তরের বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে
আমি কেবলই তাকাব আকাশের দিকে,
আর গ্রহঘুমে আছেন যারা তাঁদের জন্য
সাজাব আরেকটি পুষ্পযামিনী…