ফোন ধরতেই, বস- আগামী সপ্তাহে আমরা বন্ধু বান্ধবরা কুয়াকাটা যাব। এ আয়োজনে আপনাকে পাশে চাই। কত কথা দিলেন, কিন্তু আসলেননা। এবার আর না করতে পারবেননা। বললাম, কি যে বলেন, আপনার বাসার খাবারের কথা এখনো ভুলতে পারিনা।
কথা শেষ করতে পারিনি। কেড়ে নিয়ে বললেন, সেবার এসেছিলেন বলতে গেলে আধাঘণ্টার জন্য। আর সে সময় কুয়াকাটায়তো যাওয়া হয়নি। এবার আসেন। একেবারে একটি রিসোর্টের পুরো আপনার জন্য বরাদ্দ থাকবে। বস, না করতে পারবেননা। গত রোববারের কথা। সাংবাদিক আবু জাফর এভাবেই তার আবদার তুলে ধরেছিলেন সেদিন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি।
দুইদিন আগে জাফর ভাই ঠিকই তার বন্ধুদের নিয়ে কুয়াকাটায় যান। সেখানে উল্লাস করেন। ঘোড়ায় চড়েন। সৈকতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেন। শিকদার রিসোর্টের সামনের দঁড়িয়ে তোলা ছবি আজ মাত্র সাত ঘণ্টা আগে ফেসবুকে আপলোডও করেন। কিন্তু সাত ঘণ্টা পর তার এ আনন্দ যে গোটা পটুয়াখালীতে শোক বইয়ে আনবে কে জানতো?
প্রথম খবরটি পাই সাংবাদিক তোফাজ্জলের কাছ থেকে। শামীম ভাই, জাফর ভাই আর নেই। থ’ হয়ে যাই। মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিলনা। তার মৃত্যুর সংবাদে গোটা অফিসে নেমে আসে শোকের ছায়া।
জাফর ভাই ছিলেন বন্ধুসুলভ মানুষ। সবাইকে আপন করে নিতেন সহজে। তাইতো অফিসের প্রায় সবার সঙ্গে তার ছিল সখ্যতা। এমন হাসিখুশি মানুষটি অকালেই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমার সঙ্গে সম্পর্কটা দীর্ঘ ২৫ বছরের। মাঝখানে কিছু সময় ছাড়া এ দীর্ঘ সময় আমার সহকর্মী ছিলেন।
মফস্বল সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি দীর্ঘদিন। ফলে সারাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ছিল যোগাযোগ। কখনো জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ের সাংবাদিকদের ভালবাসা দিয়েছি। কখনো তাদের উপর রাগ করেছি। তবে আমার জানা মতে ভালবাসার চেয়ে রাগের ভাগই ছিল বেশি। জাফর ভাইও এর আওতায় ছিলেন। কখনো রিপোর্টের জন্য ধমক দিয়েছি। কখনো সময়মতো রিপোর্ট না পাঠানোর জন্য ধমক দিয়েছি। কখনো রিপোর্ট মিস করার জন্য ধমক দিয়েছি। কিন্তু তিনি যখন এক গাল হাসি দিয়ে বলতেন, বস, মাফ করে দেন। তখন চুপসে যেতাম। তার সঙ্গে আমিও হাসি দিয়ে বলতাম, দ্রুত পাঠিয়ে দিন। পরদিন পত্রিকায় বড় করে রিপোর্ট ছাপা হলে ফোনে বলতেন বস, পত্রিকাটা দেখে মনটা ভরে গেছে।
আজ খুব করে মনে পড়ছে তার নানা স্মৃতি। আমার অসুস্থতার সময় ফোন করে খবর নিয়েছেন প্রায় প্রতিদিন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার পর প্রথম ফোনে কথা হলে, আমার কণ্ঠ শুনেই-‘আল্লাহ‘ বলে জোরে একটা চিৎকার দিয়েছেন। বলেছেন, বস আপনার জন্য মসজিদে দোয়া পড়িয়েছি। সেদিনও বলেছেন, পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পটুয়াখালী আসবেন। কুয়াকাটায় নিয়ে যাব। দেখবেন শরীর পুরো ফিট হয়ে যাবে।
মানবজমিনের একযুগ পূর্তি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বরিশাল গিয়েছিলাম। জাফর ভাই ছুটে এসে আমাকে পটুয়াখালী নিয়ে যান। তার বাসায় দুপুরের খাবারের আয়োজন করেন। বড় ইলিশ মাছ, ইলিশের ডিম, আরও কত মাছ, মাংস। পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন। ভাবীকে, সন্তানদের ডেকে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আজ ভাবী বড্ড একা হয়ে গেলেন। সন্তানরা তার পিতার আদর হারিয়ে ফেললেন। তাদের সান্ত্বনা কি দিয়ে দেবো?
শামীমুল হক : সাংবাদিক
ফেসবুক থেকে