মোল্লা জালাল
স্বাধীন হয়েছি কত বছর? ৪৮। তার আগে ২৩ বছর আমরা খেয়ে-পরে কোনোমতে বেঁচে ছিলাম তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাস যুদ্ধ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম।
স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। সে সময়ে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কোনো উপায় ছিল না। পাক বাহিনী গোটা দেশটাকেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধু দিশেহারা হয়ে ছুটছিলেন, কীভাবে দেশের মানুষকে বাঁচানো যায়, দেশটাকে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দেয়া হয়নি। ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের নজিরবিহীন বর্বরতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
’৭৫ থেকে ২০১৯ সাল ৪৪ বছর। এর মাঝে কুড়ি বছরের বেশি সময় গেছে দেশটাকে লুটেপুটে খাওয়ার মহোৎসবে। ’৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে সরকার গঠন করলে নতুন যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ৫ বছর পর আবার ব্যাঘাত ঘটে। ২০০১ সালে আবার লুটের রাজ্যে পরিণত হয় বাংলাদেশ। এরপরে যায় ১/১১-এর অধীনে। ২০০৮ সালে আবার আওয়ামী লীগ মহাজোট করে ক্ষমতায় আসে। বলা যায়, এখান থেকেই শুরু। ২০০৮ থেকে ২০১৯- এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ আজ কোথায় চলে গেছে, দেশের বাইরে না গেলে কারও পক্ষেই তা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। বিশ্বের এমন কোনো দেশ বা জাতি নেই যারা আজ বাংলাদেশকে জানে না, চেনে না।
এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশেনে সারা বিশ্বের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা যোগ দিয়েছেন। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই গিয়েছেন নিজ নিজ দেশের বিভিন্ন পেশার শতাধিক সংখ্যারও বেশি লোকের বহর। নিউইয়র্কের ঐতিহ্যবাহী গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে বাংলাদেশিদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন প্রশাসন অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় বাংলাদেশিদের।
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আবাসস্থল ছিল অভিজাত হোটেল লোটে নিউইয়র্ক প্যালেসে। জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন চলাকালে এই হোটেলেই অবস্থান করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
বিশ্বের শতাধিক দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় সম্মেলনে আসা রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে জাতিসংঘ সদর দফতরে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেন সংস্থার মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। নর্থ ডেলিগেটস লাউঞ্জের মধ্যাহ্নভোজে জাতিসংঘ মহাসচিব নিজ টেবিলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অতিথিদের নিয়ে বসেছিলেন। ওই টেবিলে ডোনাল্ড ট্রাম্প, এঞ্জেলা মার্কেলের পাশে বসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দক্ষিণ এশিয়ার কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের জায়গা হয়নি ওই টেবিলে। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদের মতো গুরুত্বপূর্ণ নেতাও ওই টেবিলে আমন্ত্রিত হননি।
আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের সম্মানে নৈশভোজ দিলেন, সেখানেও গুরুত্ব পেলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাছাড়াও শেখ হাসিনার সঙ্গে তার হোটেলে সাক্ষাৎ করতে যান বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধনী বিল গেটস।
বিল গেটস ছাড়াও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউটর ফাতো বেনসুদা, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রানডি এবং ইউনেস্কোর সাবেক মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভাও আলাদাভাবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনার অসামান্য অবদান ও কৃতিত্বের কারণে জাতিসংঘ অধিবেশনে তার হাতে তুলে দেয়া হয় দুটি পুরস্কার। বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ সম্মাননায় ভূষিত করে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন। এ পুরস্কার তার হাতে তুলে দেন বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে খ্যাতিমান এনগোজি ওকোনজো-আইয়েলা।
এ এনগোজি ওকোনজো-আইয়েলা নাইজেরিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার অন্যতম বড় ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারের পরিচালনা পর্ষদেরও সদস্য এনগোজি। পুরস্কার তুলে দেয়ার আগে এনগোজি ওকোনজো-আইয়েলা শেখ হাসিনাকে যেসব বিশেষণে প্রশংসা করলেন তা সত্যিই অবিস্মরণীয়।
ভ্যাকসিন হিরো ছাড়াও তরুণদের দক্ষতা উন্নয়নে ভূমিকার স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘চ্যাম্পিয়ন অব স্কিল ডেভেলপমেন্ট ফর ইয়ুথ’ সম্মাননায় ভূষিত করে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল (ইউনিসেফ)।
এই দুটি পুরস্কার একসঙ্গে পাওয়া একটি বিরল ঘটনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের যে মর্যাদা বেড়েছে তার প্রমাণ মিলে বহুমাত্রিকভাবে। আমেরিকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত বাংলাদেশি একাধিক লোককে দেখেছি স্বচ্ছন্দচিত্তে মার্কিনিদের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে। তাদের আচার-আচরণে বাংলাদেশি সহকর্মীদের প্রতি সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টিও প্রত্যক্ষ করেছি। অধিবেশনে যোগ দেয়া রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি বিশ্ব নেতারা যে আগ্রহ দেখিয়েছেন, গুরুত্ব দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছেন, খানিকটা দূর থেকে নিজের চোখে সব কিছু দেখেছি। বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায় শেখ হাসিনার বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে আমার কাছে নরেন্দ্র মোদি বা ইমরান খানের চেয়েও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অনেক বেশি আত্মপ্রত্যয়ী মনে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী অধিবেশন চলাকালীন বিরতিহীন প্রোগ্রাম করেছেন। সফরসঙ্গী সাংবাদিকরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছুটতে ছুটতে টায়ার্ড হয়ে গেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী একের পর এক কাজ করে গেছেন। তার এই বিরতিহীন ছুটে চলায় বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত। যদি তর্কের খাতিরে বাংলাদেশকে এখনও গরিব দেশ হিসেবে ধরে নেই, তাহলে মূল্যায়ন করা দরকার কতটা গরিব। বাংলাদেশে কী নেই, বাঙালিরা কী পায় না, কী খায় না বা কী পরে না? বাংলাদেশের মানুষের কোন সাধ-আহ্লাদটি অপূর্ণ? প্রায় ১৭ কোটি মানুষের এ বাংলাদেশে নিজেদের উপার্জনে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা একটি বিস্ময়কর বিষয়।
আমি এবারই প্রথম আমেরিকা গেলাম। আর একবারেই বুঝলাম আমেরিকা শুধু মার্কিন মুলুকের রাজধানী নয়, আমেরিকা পৃথিবীর রাজধানী। প্রতিদিন সমগ্র পৃথিবী থেকে হাজার হাজার মানুষ আমেরিকা আসছে-যাচ্ছে। এ আসা যাওয়ার মূল কারণ, আমেরিকা সবার কাছেই স্বপ্নের দেশ। কিন্তু মার্কিনিরা আছে তাদের মতোই। তারা আবেগে গা ভাসায় না বা হুজুগে চলে না। তাদের কাজকর্ম-চিন্তাভাবনা সব কিছুতেই গতি। যে দিকে তাকাবেন দেখবেন মানুষ ছুটছে আর ছুটছে। কারও সঙ্গে কারও এক দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলার ফুরসত নেই। হাঁটছে, খাচ্ছে, কাজে যাচ্ছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের লাখ লাখ জনশক্তি দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে কাজকর্ম করে খাচ্ছে। নিউইয়র্কের জনএফ কেনেডি বিমানবন্দরে বাংলাদেশি একজন ট্রলি বয় পেয়েছিলাম। তার বাড়ি সুনামগঞ্জে। ওখানে তার মতো পাকিস্তানি ও হিন্দুস্তানিরাও কাজ করে। দুবাই বিমানবন্দরেও একাধিক বাঙালি পেয়েছি। কাজ করছে। হোক না ছোট কাজ। যার যেমন যোগ্যতা। কিন্তু এই স্বল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষগুলো বিদেশে গিয়ে যে আত্মপ্রত্যয় আর সাহস নিয়ে জীবন সংগ্রামে সাফল্য অর্জন করছে তাকে স্যালুট করতে হয়। এই মানুষগুলোর সাহসের আরেক নাম শেখ হাসিনা।
আমেরিকার অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রথমত সময় কম, দ্বিতীয়ত আমি বেশি হাঁটতে পারছিলাম না। আমেরিকায় হাঁটতে হয়। তারপরও যেটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশি খাবার খেতে একদিন গেলাম জ্যাকসন হাইটসে। বলা যায় মিনি বাংলাদেশ। সেখানে আছে লাবলু আনসার। প্রবাসী সাংবাদিক। বাংলাদেশ প্রতিদিনের আমেরিকা প্রতিনিধি। আমি আর কাজী রশিদুল হক পাশা ভাই একসঙ্গে ছিলাম। লাবলু সারাক্ষণ লেগেছিল আমাদের দেখভাল করায়। প্রায় দিনই নিজে গাড়ি চালিয়ে আমাদের ম্যানহাটনের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বলে গেছে আবার সকালে আসবে। জ্যাকসন হাইটসে কর্মরত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের আন্তরিকতায় সত্যি আমরা মুগ্ধ। লং আইল্যান্ডে থাকেন আমাদের সবার প্রিয় বাংলার বাণীর সাবেক চিফ রিপোর্টার দাউদ ভূঁইয়া। তিনি তার গাড়ি নিয়ে আমাদের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম হেলাল ভাই এবং ওয়াশিংটনে নিয়োজিত প্রেস মিনিস্টার শামীম ভাই শত ব্যস্ততার মাঝেও হোটেলে গিয়ে আমাদের খোঁজ খবর নিয়েছেন। শামীম ভাই জ্যাকসন হাইটসে এসে দীর্ঘক্ষণ আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। নিউজ কভার করার জন্য বাংলাদেশ থেকে যেসব সহকর্মী বন্ধুরা এবার জাতিসংঘে গিয়েছিলেন, তারা যে কী অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। সারাক্ষণ তাদের দৌড়ের ওপর থাকতে হয়েছে। তাও আবার হেঁটে। কারণ আমেরিকায় আমাদের দেশের মতো যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং করা যায় না। সাংবাদিকদের এ পরিশ্রমের বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীর চোখ এড়ায়নি। তিনি সব দিকে খেয়াল রেখেছেন। সবসময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে সাংবাদিকদের খোঁজখবর নিয়েছেন।
আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের আত্মপ্রত্যয় আর কর্মস্পৃহা দেখে অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম সারা দুনিয়া থেকে বাংলাদেশিরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দেশে যে টাকা পাঠায় সে টাকা যদি সঠিক কাজে বিনিয়োগ করা হতো তাহলে দেশে যেমন ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হতো, তেমনি বাংলাদেশটা আজ অনেক উপরে থাকত।
আমেরিকা থেকে ফিরে আসার সময় আমার পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। একেবারেই হাঁটতে পারছিলাম না। সহযাত্রী সাংবাদিক ফারজানা রূপা ও রিয়াজুল বাশার অনেক সহায়তা করেছেন। বিশেষ করে রূপা দৌড়াদৌড়ি করে আমার জন্য ট্রলি সংগ্রহ করে দেয়ায় আমার ফিরে আসা সহজ হয়েছে। তাদের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন ওই সময়ে আমেরিকায় ছিলেন। তিনিও আমার খোঁজখবর রেখেছেন। দেশে ফিরে কোনোমতেই মিলাতে পারছি না, বাইরে কোন বাংলাদেশ দেখে এলাম আর দেশে এসে কী দেখছি।
মোল্লা জালাল : সভাপতি, বিএফইউজে