শাহ মতিন টিপু: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ১০ জানুয়ারি হলেও তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন তার দু’দিন আগে।
১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তিলাভের পর তিনি লন্ডন যান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উড্রো উইলসনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘরোয়া বৈঠক করেন। তারপর দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ রাতে গ্রেপ্তারের পর সুদীর্ঘ সময় বন্দী জীবনেই থাকতে হয়েছে। রবার্ট পেইনের বর্ণনায়- ২৫ মার্চ রাতে আপন আলয় থেকে গ্রেপ্তারের পর কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে টেনশনের অবরুদ্ধ ছ’টি দিন। তারপর স্থানান্তর ঢাকা থেকে করাচি। পরের দিন মিয়ানওয়ালি কারাগারে। চার মাস পরে লায়ালপুর কোর্টে আসামির কাঠগড়ায়। এভাবে জেলজীবনে পাকিস্তানের কারাগারেই কাটে মুক্তিযুদ্ধকালে জাতির জনকের পুরোটা সময়। কারাগারে দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে মৃত্যুর প্রচ্ছন্ন হুমকিতে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ উল্লাসে মেতে ওঠে। কিন্তু তখনও শঙ্কা কাটেনি। কারণ যার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে তিনি তখনও পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ১৬ ডিসেম্বরের পর সরিয়ে নেয়া হয় কারাগার থেকে দূরে আরো দুর্গম জায়গায়।
২৪ ডিসেম্বর, একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রশ্ন করেন, তাকেও বন্দী করা হয়েছে কিনা।
জবাবে ভুট্টো বলেন, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।
‘কিভাবে তুমি প্রেসিডেন্ট হও, যেখানে তোমার চেয়ে নির্বাচনে আমি দ্বিগুণ আসন পেয়েছি?’- হেসে জানতে চান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো উত্তর দেন, তুমি যদি চাও তাহলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারো।
দৃঢ়কণ্ঠে জাতির জনক জবাব দিয়েছিলেন, “না, আমি চাই না। তবে যত দ্রুত সম্ভব আমি বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।”
বঙ্গবন্ধুকে ভুট্টো জানান, এজন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি নেবেন, তবে তার জন্য কয়েকদিন সময় লাগবে।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এসব আলোচনা ভুট্টো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাপ করেন। যার নথি পাওয়া যায় পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস থেকে ৩ জানুয়ারি, ১৯৭২ এ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো এক গোপন টেলিগ্রাম থেকে।
টেলিগ্রামে বলা হয়, “মুজিব বাইরের জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তিনি (মুজিব) হয়তো মনে করছিলেন, বড় একটি অংশে যুদ্ধ চলছে, হয়তো পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ ভারত দখলে নিয়েছে। তবে তার কোনো ধারণাই ছিল না পাকিস্তানের কী করুণ পরাজয় ঘটেছে”।
এতে আরো বলা হয়, “তার চারপাশের অবস্থার পরিবর্তনে বেশ অবাক মনে হচ্ছিল মুজিবকে। সেইসঙ্গে হতাশ হয়েছিলেন যখন জানতে পারেন ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সবটাই দখলে নিয়েছে। ভুট্টো আরও বলেন, কথোপকথনের সময় শেখ বার বার ভারতীয় দখল এবং আধিপত্যবাদের কথা বলছিলেন এবং তিনি তা মেনে নেবেন না বলেও জানান।”
পরবর্তী কয়েক দিন কেটে যায় বাংলাদেশে ফিরে আসার ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ জানাতে। যেহেতু ৯০ হাজারের বেশি পাকিস্তানি সেনা বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দী, বঙ্গবন্ধুর দ্রুত ও নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা হবে এটা নিশ্চিতই ছিল।
লন্ডনে যাওয়ার আগে তাদের সৌজন্যে প্রেসিডেন্টের অতিথি ভবনে ভুট্টো নৈশভোজের আয়োজন করতে চান। ভুট্টো আসেন এবং কুশলাদি বিনিময়ের পর বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখেন।
বঙ্গবন্ধু উত্তর দেন, ‘তুমি যদি আমাদের কথা শুনতে তবে রক্তপাত এড়ানো যেতো এবং পরবর্তীতে যা কিছু ঘটেছে তাও। কিন্তু তুমি নির্মম সশস্ত্র হামলা চালিয়েছ। দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে যে সম্পর্ক তা ছাড়া আর কিভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে তা আমি জানি না’।
ভুট্টো বারবার বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ পুনর্বিবেচনার কথা জানালে, বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি এর উত্তর দেবেন।
তারপরেই ভুট্টো এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রস্তাব রাখেন। তিনি জানান, ইরানের শাহ পাকিস্তান সফরে আসছেন এবং তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। আর এ কারণে বঙ্গবন্ধুর যাত্রা পরদিন সকাল পর্যন্ত পেছাতে পারে।
এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, রাতেই তাদের যাত্রার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে এবং জানান ইরানের শাহের সঙ্গে দেখা করার কোনো ইচ্ছা তার নেই। আর যদি নির্ধারিত সময়ে লন্ডন যাত্রার ব্যবস্থা ভুট্টো না করতে পারেন, তাহলে যতদ্রুত সম্ভব তাদের কারাগারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে।
বঙ্গবন্ধুর ক্ষোভ বুঝতে পেরে ভুট্টো জানান, নৈশভোজের পরেই করাচি থেকে তাদের যাত্রার নির্দেশ দেয়া হবে।
বঙ্গবন্ধুকে এরপর বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। সঙ্গে ড. কামাল হোসেন। বঙ্গবন্ধুকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত এগিয়ে দেন ভুট্টো। তাদের বলা হয়, যাত্রা সম্পর্কে এখনই কিছু জানানো হবে না, যখন লন্ডন থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বে থাকবে উড়োজাহাজ তখন ঘোষণা দেয়া হবে। যখন তারা লন্ডনের কাছাকাছি পৌঁছাবেন, তখন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষকে একটি বার্তা পাঠানো হবে, যাতে থাকবে বঙ্গবন্ধু সকাল সাতটার দিকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছাবেন।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশের মাটিতে পা রাখেন দুই দিন পরে ১০ জানুয়ারি। জনতার ঢল নামে। বিমানবন্দর এলাকা লোকারণ্য। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন বঙ্গবন্ধু, নাতিদীর্ঘ ভাষণে জাতিকে দেন দিক নির্দেশনা।
(রাইজিংবিডি থেকে)