আ হ ম ফয়সল: এখন আমার আয় বাড়ছে, পাশাপাশি পরিবারগুলো যাদের পরিবহনের সমস্যার কারনে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে পারত না তারা এখন আমার মাধ্যমে খুব সহজে স্বাস্থ্য সম্মত টয়লেট সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারছে।
এই রিং স্লাব ব্যবসার লাভের টাকা থেকে বাড়ী বানানোর কাজে প্রায় ১ লাখ টাকা ব্যয় করি। আমার পরবর্তী পরিকল্পনা নিজের টাকা দিয়ে নৌকা কিনে আরো স্বল্প মূল্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলের পরিবার গুলির মধ্যে স্যানিটেশন সামগ্রী পৌছে দেওয়া। এখন মনে হয় আমি আমার ব্যক্তিগত আয়ের পাশাপাশি এলাকার মানুষের সুস্বাস্থ্য রক্ষায় কিছুটা হলেও ভুমিকা রাখতে পারছি। এখন আমি পরিবার পরিজন নিয়ে খুব সুখে আছি। পুলিশ প্রশাসনের কোন চাপ নেই, আমার নামে এখন আর কোন মামলা নেই, এখন ‘রাত্রিতে খুব শান্তিতে ঘুমাইতে পারি’।
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন, বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার নিশানবাড়ীয়া ইউনিয়নের গুলিশাখালী গ্রামের মোঃ নুরু মুন্সি।
নুরু মুন্সি বেসরকারি সংস্থা ডরপ পানিই জীবন প্রকল্পের মাধ্যমে স্যানিটেশন উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন স্থানীয়ভাবে ব্যবসা করছেন। এ ব্যবসা করে তার মধ্যে এখন স্বস্তির নিশ্বাস বইছে। এক সময়কার নুরু মুন্সির অভাবের তাড়নায় জড়িয়ে পড়েছিলেন সুন্দর বনের গাছ চোরাচালানি পেশায়।
তিনি আমাদের জানান, পিতার মৃত্যু সময় ৬ মাস এবং ৭ বছর বয়সে তার মা মারা যায়। অভাবের সংসার ও শাসনের অভাবে লেখা পড়া বেশী করতে পারিনি। এক পর্যায়ে যখন উপার্জনক্ষম বয়সে সংসার চালানোর ভার আসে তার কাধে। দাদা-দাদি ৩ ছেলে ও স্বামী স্ত্রী মিলে মোট -৭ জনের সংসার, যা চালাতে হিমশিম খেতে হতো। এলাকায় ভাল আয়ের উৎস না থাকায় বেশী আয়ের জন্য অন্য কয়েকজনেরমত সুন্দর বনের গাছ চোরাচালানি পেশায় জড়িয়ে পড়েন।
দিন যায়, আয় মোটামোটি ভাল হতে থাকে, তবে প্রশাসনের চাপ বাড়তে শুরু করে, অন্য দিকে সন্তান বড় হতে থাকে, তাদের সমাজে এই পেশার জন্য মান সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাড়ায়। এই অবৈধ পেশার কারনে তার নামে সরকার বাদী হয়ে ৪টি মামলা করে। একদিকে প্রশাসনের চাপ, অন্য দিকে পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে নুরু মুন্সি এই পেশা ছেড়ে দেয়। পেশা ছেড়ে দেয়ার পর কাজের সন্ধানে প্রায় তিন চার মাস চলে যায়। সঞ্চয়কৃত কিছু টাকা ছিল তাও এক সময় সংসার চালাতে গিয়ে ফুরিয়ে যায়। কিছু দিন পরে সংসারে আবার সেই অভাব ফিরে আসে।
কিছুদিন পর (২০১৭ সালের দিকে) বেসরকারি সংস্থা ডরপ এর পানিই জীবন প্রকল্পের স্বাস্থ্যগ্রাম দলের মাধ্যমে স্যানিটেশন উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। নুরু মুন্সি বলেন, ‘আমি প্রথমে বুঝিনি স্যানিটেশন উদ্যোক্তা কি জিনিস? পরে বুঝতে পারলাম যে টয়লেট/রিং স্লাব তৈরী ও বিক্রি করে লাভবান হওয়া সেই প্রশিক্ষণ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩দিনের উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নেই। এর পর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য উপকরণ, ও মালামাল তৈরীর ফরমার জন্য অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। স্থানীয় অন্য একটি এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে রিং-স্লাব তৈরীর কারখানা চালু করার কাজ শুরু করি।’
একদিকে প্রশিক্ষণের দক্ষতা, অন্যদিকে পরিশ্রম, এই দুইয়ে মিলে ধীর ধীরে এগোতে থাকে নুরু মুন্সির রিংস্লাব বিক্রির ব্যবসা। অল্প কিছু দিনের মধ্যে আশ পাশের ৩ জন নারীকে রিং স্লাব তৈরীর জন্য একাধারে ৮-১০ দিন প্রশিক্ষণ দিলাম। নারী কারিগরের মাধ্যমে কারখানায় উৎপাদন বাড়তে শুরু হলো, বিক্রি বেশী হতে লাগল ও আয় বাড়তে লাগলো তার। তার কারখানা থেকে প্রত্যেক নারী শ্রমিক গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ২শ টাকা আয় করে থাকেন। ইতোমধ্যে ৩০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করে নতুন করে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। এখন নুরু মুন্সির বড় ছেলে মোটর সাইকেল চালানো পেশায়, মেজো ছেলে একটি মুদি দোকান চালায় আর ছোট ছেলে ১০ম শ্রেনীতে পড়া লেখা করছে। এখন মাসে ২০-২২ হাজার টাকার রিং-স্লাব বিক্রি হয়। এরই মধ্যে রিং স্লাব ব্যবসার লাভের টকা থেকে বাড়ি বানানোর কাজে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ করেছেন নুরু মুন্সি।
তিনি আমাদের বলেন, ‘গ্রামে রিং-স্লাব পৌছানোর সমস্যা দেখে ডরপ এর কর্মকর্তাদের পরামর্শে পাশের গ্রামের একজনের একটি নৌকা ভাড়া করলাম, প্রতিবার ২০০ টাকা ভাড়া চুক্তিতে উক্ত নৌকায় ১০-১৫ সেট ল্যাট্রিন বোঝাই করা যায় এবং প্রতি মাসে কম পক্ষে ৩-৪ বার খালের মধ্য দিয়ে গ্রামে গ্রামে পৌছে দিতে পারছি। এর ফলে আমার যেমন আয় বাড়ছে পাশাপাশি পরিবারগুলি যাদের পরিবহনের সমস্যার কারনে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ব্যবহার করতে পারত না তারা এখন আমার মাধ্যমে খুব সহজে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট সংগ্রহ ও ব্যবহার করতে পারছে। এটা আমার অনেক ভালো লাগে’।