মোল্লা জালাল
দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণা করায় সমাজের সকল স্তরে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে এসেছে।
করোনাভাইরাসের এই আপৎকালে অর্থনীতি বিশ্লেষকরাও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রণোদনার প্রশংসা করছেন। মোদ্দা কথা, কেউই এর সমালোচনা করছেন না। কারণ, এর সঠিক ব্যবহার করা হলে সমাজের কোনো পেশার লোকজন জীবিকার সংকটে পড়বেন না। দেশের অর্থনীতি কমবেশি সচল থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই প্যাকেজ ঘোষণার আগে যারা দলবেঁধে সরকারের কাছে গিয়ে বলেছিলেন যে, টাকার অভাবে তারা চলতে পারছেন না। তাড়াতাড়ি টাকা না দিলে মহাবিপদ হবে। প্যাকেজ ঘোষণার পর তারাও চুপ। এ পর্যন্ত তাদের নাখোশ হওয়ার কোন কথা শোনা যায়নি। তার মানে হচ্ছে, তারাও এই প্যাকেজ সুবিধার অংশীদার হতে যাচ্ছেন।
ইতোধ্যেই সরকারের তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, দিনমজুর থেকে শুরু করে শিল্পপতি সকলেই প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা পাবেন। তথ্যমন্ত্রী সঠিক কথাই বলেছেন। কারণ, প্যাকেজটি কোনো দান বা রিলিফ নয়। এটি শিল্প ও ব্যবসায়ী খাতের মূলধন সহায়ক তহবিল। প্রত্যেক মালিক নিজ নিজ প্রয়োজন মোতাবেক এই প্যাকেজের আওতায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিবেন এবং তাদের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু রাখবেন। ব্যাংক ঋণের যে সুদ হবে তার বড় অংশ সরকার দেবে আর ক্ষুদ্র অংশ ঋণগ্রহীতা দেবেন।
অনেকের প্রত্যাশা ছিল, সরকার এই সময়ে সেক্টরভিত্তিক নগদ আর্থিক সহায়তা দেবে। এর মধ্য অন্যতম ছিল দেশের সংবাদকর্মীরা। কিন্তু তা হয়নি। সরকারের এই প্রণোদনার সুযোগ পাবেন প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। যদিও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সবাই যেন সরকারের দেওয়া এই সুযোগকে সঠিক কাজে ব্যবহার করেন।
সরকারের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অন্যান্য সেক্টরের মালিকরা কি করবেন জানি না। তবে গণমাধ্যম মালিকরা এই সুবিধার কত পার্সেন্ট সঠিক ব্যবহার করবেন সে বিষয়ে সন্দেহ ও সংশয় রয়েছে। ঢাকাসহ সারাদেশে ইতোমধ্যেই অনেক সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে করপোরেট মালিকানার একাধিক প্রতিষ্ঠানও আছে। তারা সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়ার আগে কারো সাথে কোনো আলোচনাও করেননি। প্রতিষ্ঠানের কর্মরত সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়াসহ চলতি মাসের বেতনের কি হবে সে বিষয়েও কোনো কিছু বলেননি। বন্ধ করার নোটিশে শুধু বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে সংবাদপত্রের প্রিন্ট ভার্সন বন্ধ করে দেওয়া হলো। তবে অনলাইন ভার্সন চালু থাকবে।
প্রধানমন্ত্রীর এই বিশাল অংকের প্রণোদনার প্যাকেজ ঘোষণার আগে দেশের গণমাধ্যমের মালিকদের বেশ কয়েকবার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিএফইউজে এবং ডিইউজে বিবৃতি দিয়ে করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে সংবাদকর্মীদের জীবনের ঝুঁকির দিকটি বিবেচনায় রেখে তাদের সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু ইউনিয়নের আহ্বানে সাড়া মেলেনি। সংবাদকর্মীদের সুরক্ষায় ন্যূনতম কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি দু-একশ টাকার মাস্ক, গ্লাভস এবং সেনিটাইজারের ব্যবস্থাও করেনি। তারপরও সংবাদকর্মীরা নিজ উদ্যোগে এসব উপকরণ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছেন।
অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা ঘোষণার পর গণমাধ্যম মালিকরা সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার ব্যাপারে যেন উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তার কথা বলে একের পর এক সংবাদপত্র বন্ধ করে দিচ্ছেন। অথচ কেউই সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারীদের বকেয়াসহ চলতি মাসের বেতনের কথা বলছেন না। কোনোপ্রতিষ্ঠানেই বেতন প্রদানের খবর পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে,করোনার ভয়ে সংবাদকর্মীদের অফিসে যাতায়াত বন্ধ করার মধ্য দিয়ে কি তাদের জীবিকা নিশ্চিত হয়ে গেছে? চারদিকে লকডাউন। সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। ঘরে থাকলেও তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। তার উপায় কি? মালিকরা যদি সংবাদকর্মীদের পাওনা পরিশোধ না করেন, বেতন না দেন তবে চলবে কীভাবে। মালিকরা ৭৩ হাজার কোটি টাকায় দাও মারতে পারবেন। কিন্তু সংবাদকর্মীদের তো সে সুযোগ নেই। তারা কোথায় যাবেন। কি খাবেন, কীভাবে চলবেন।
এসব বিষয়ে কথা বল্লেই সংবাদকর্মীদের মধ্য একটি শ্রেণি আছে, যাদের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। তারা বলেন, মালিকরা তো অবশ্যই পাওনা টাকা দেবেন। এতো অস্থির হওয়ার কি আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মালিকরা যথাযথভাবে তা দেন না। তার একাধিক নজির আছে। সংবাদপত্রের ইতিহাসে ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজারভার একেকটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যাদের চাকরি গেছে তাদের বহুজন বছরের পর বছর ধরে পাওনা টাকার চেক নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু টাকা পাচ্ছেন না। অনেকে মামলা করেও টিকতে পারেননি। আপিলের পর আপিলের সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্লান্ত হয়ে রক্ত-ঘামে অর্জিত পাওনা টাকার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে মারাও গেছেন। তখন সংবাদপত্র ছিল একক মালিকানার প্রতিষ্ঠান। আর এখন সবগুলোই করপোরেট হাউস। যে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এবং কার্যকর করার ক্ষেত্রে জনে জনে মতামত ও ঐকমত্যের প্রয়োজন।
তারপরও কিছুটা হলেও সান্তনা পাওয়া যেতো যদি পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা করার আগে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা করে টাকা-পয়সা কখন কীভাবে দেবেন এসব বিষয়ে সমঝোতা করে নেওয়া হতো। যেহেতু মালিকরা এসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেননি, সেহেতু অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সংবাদকর্মীদের দুর্ভোগ আরো বাড়লো।
বন্ধ অফিস যদি কোনোদিন খোলা হয় তবে সে সময়ে আজকে যারা কর্মরত ছিলেন, তাদের সবাই যে কাজ ফিরে পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারপরও অনলাইনে পত্রিকা থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার প্যাকেজে দাও মারার ফন্দি-ফিকিরি চলবে, টাকার অভাবে সংবাদপত্র বন্ধ দেখিয়ে প্রণোদনার সুবিধায় বস্তা ভরবে। ইতোমধ্যেই তার আলামত শুরু হয়েছে। যে সব সংবাদপত্র নিয়মিত প্রকাশ হয়না, সাংবাদিক-শ্রমিক-কর্মচারি কিছুই নেই তারাও মন্ত্রনালয়সহ ব্যাংকে দৌড় ঝাপ শুরু করেছেন প্রনোদনার ভাগ নিতে। বলা যায় নিয়েও যাবে। কারন, প্রধানমন্ত্রীতো আর খাজানা পাহারা দেবেন না। যাদের হাতে বন্টনের দায়িত্ব তাদেরকে কেমনে ম্যানেজ করতে হয়, মালিকরা ভাল করেই জানেন। সুতরাং কোনো কিছুই বাদ যাবে না। কেবল দুর্বিষহ হবে সংবাদকর্মীদের জীবন-জীবিকা।
এই লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন সেক্টরের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকরা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ চাকরি হারানোর কোনো আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন। কিন্তু গণমাধ্যমের কোনো মালিক এ পর্যন্ত কোনো আলোচনা দূরে থাক একটা ঘোষণা পর্যন্ত দেননি যে, সংবাদপত্র বন্ধ হলেও কারো চাকরি যাবে না, সবাই বেতন পাবেন।
এ অবস্থা থেকে সংবাদকর্মীদের কেউই উদ্ধার করবে না। সহযোগিতার হাতও বাড়াবে না। মাঝেমধ্য সেলফি তুলে ফেসবুকে দেওয়ার জন্য রিলিফ নিতে ডাকবে। এমতাবস্থায় সাংবাদিকরাই পারেন নিজেদের জীবন-জীবিকা রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার মহাসড়কে দেয়াল তুলে দিতে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক বিটের সাংবাদিকরা গণমাধ্যমকর্মীদের রক্ষায় বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন।
ইআরএফ একটি বড় সংগঠন। দেশের সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের খবরাখবর তাদের নখদর্পণে। প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনার প্যাকেজে কোন কোন গণমাধ্যম মালিক কত টাকার দাও মারার পরিকল্পনা করছেন, ইআরএফ সদস্যরা সবই জানতে পারবেন। এক্ষত্রে সংবাদকর্মীদের বেতন খেলাপি মালিকদের বিষয়ে ব্যাংক এবং সরকারকে তথ্য প্রদান করা হলে কিছুটা হলেও লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে। পাশাপাশি বিষয়গুলো ইউনিয়নকে জানালে ইউনিয়নও যৌক্তিকভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয় টাকায় এই প্রণোদনার প্যাকেজ দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠান চালু রাখার সহায়তা হিসেবে। শ্রমিক-কর্মচারীদের পেটে লাথি মেরে সুবিধার বস্তা ভরার জন্য নয়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, ইউনিয়ন আইন প্রণয়ন করতে পারে না। প্রচলিত আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ইউনিয়ন তা করছে। কিন্তু গণমাধ্যম মালিকরা তা মানছেন না। সরকারও কঠোর কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সুতরাং সার্বিক দিক বিবেচনায় সময় এসেছে সত্যিকার অর্থেই রুখে দাঁড়াবার। তা করতে না পারলে শুধু ফেসবুকে নানা কথা লেখালেখি করে লোক হাসিয়ে কিছু হবে না। “বেচু বেচুর তালেই থাকবে”।
মোল্লা জালাল: সাংবাদিক নেতা, সভাপতি- বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)।