এস এম ইলিয়াস জাবেদ,কলাপাড়া: করোনা সংক্রমণ এড়াতে সরকারের নির্দেশনায় ঘরে থাকা কর্মবিমূখ দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের মাঝে সরকারের দেয়া ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে দুস্থদের নিয়ে চলছে ছবি তোলার হিড়িক। যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে সামাজিক দূরত্ব রক্ষার নির্দেশনা না মেনে দুস্থদের ক্যামেরার দিকে তাক করিয়ে ৫-১০ জন মিলে ত্রাণ দিচ্ছেন একজনকে। একজনকে একটি সাবান, টিস্যু দিতে দেখা গেছে ১০জনকে। ছবি তোলা থেকে দুস্থদের বাদ দেয়নি সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি কিংবা জনপ্রতিনিধি কেউই।
এমনকি এনজিও ওয়ার্ল্ড কনসার্ন’র কর্মীদের বিরুদ্ধে দুস্থ মানুষের হাতে ত্রাণ সামগ্রী দিয়ে ছবি তোলার পর আবার ফিরিয়ে নেয়ারও অভিযোগ উঠেছে কলাপাড়ায়। যদিও এ নিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ল্ড কনসার্ন’র দায়িত্বশীল সূত্র বলছে তাদের ওয়ার্ড দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক সদস্য যুবদলের সাথে যুক্ত হওয়ায় তার প্রতিপক্ষরা প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে তার বিরুদ্ধে।
এছাড়া তারা সীমিত পরিসরে ৫টি ইউনিয়নে তাদের সংগঠনের সাথে যুক্ত ১৫০০জন দুস্থ পরিবারকেই কেবল ত্রাণ দিয়েছেন।
তবে শহর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দেখা গেছে ছবি তোলা ছাড়া ত্রাণ দেয়া হচ্ছেনা দুস্থদের। অবস্থা দৃষ্টে এমনই মনে হচ্ছে যে দুস্থদের ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া যেন মুখ্য নয়, নেতার ত্রাণ বিতরনের ছবি তোলাই যেন মুখ্য।
স্থানীয় নির্ভরযোগ্য সূত্র ও জনসংখ্যা বিভাগের তথ্য মতে, উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভায় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ বসবাস করে। এদের মধ্যে শতকরা ২৪ ভাগে মানুষ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। এদের মধ্যে প্রান্তিক জেলে, কৃষক, দিনমজুর, ঠেলা গাড়ী-ভ্যান শ্রমিক, রিক্সা শ্রমিক, অটো শ্রমিক, বাস-ট্রাক শ্রমিক, মৎস্য শ্রমিক, ধোপা, নাপিত, মুচি, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ইটভাটা শ্রমিক, স্বমিল শ্রমিক, কাঠ মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, হেলপার, মাটি কাটা শ্রমিক, ভিক্ষুক সহ নানান পেশার অন্তত: ৫০ হাজার মানুষ রয়েছে। যারা করোনা সংক্রমন এড়াতে লাগাতার ঘরে বসে থাকায় উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে।
এতে ওই সব পরিবারে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় সরকার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে তাদের খাদ্য সহায়তার জন্য ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করছে। আর এ বিতরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করছে স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যানগণ।
এছাড়া সামাজিক সংগঠন সহ ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এতে দুস্থদের দেয়া সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর সুবিধাসহ অপ্রতুল ত্রাণ বিতরণে রাজনৈতিক বিবেচনা আমলে নেয়ায় অভিযোগ উঠছে। ত্রাণ বিতরণে নেতার কর্মী, সমর্থক, অনুসারী কিনা যাচাই করার অভিযোগ উঠছে। নির্বাচনে পক্ষ করা না করারও কথা উঠছে তৃণমূলে।
টিসিবির এক ডিলার কেবল তার নির্বাচনে পক্ষ করা অনুসারীদের জানিয়ে পন্য বিক্রি করছে এমনও অভিযোগ করেছেন এক ইউপি চেয়ারম্যান। ত্রাণ বিতরনে ক্ষুধার্ত মানুষকে মানবিক বিবেচনায় না দেখে- দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে।
এছাড়া ৫০ হাজার দরিদ্র মানুষের মধ্যে মাত্র দু’চার হাজার দরিদ্র মানুষ ত্রাণ সুবিধা পেয়েছে। ত্রাণ বিতরনের সময় তাদের ক্যামেরার দিকে তাক করে নেতার অনুসারীরা ছবি তুলে নেতার সন্তুষ্টি অর্জনে তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। একজন দুস্থ মানুষও ত্রাণ হাতে নিয়ে ছবি তোলা থেকে বাদ যায়নি। ৫-১০ কেজি চাল, দুই কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি লবন, ৫০০ মি.লি. তেল ও ১টি সাবান সম্বলিত এ সহায়তায় কিছু পরিবারের ৪/৫ দিন হলেও অধিকাংশ দরিদ্র পরিবারে চলছে সংকট।
এছাড়া কিছু মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ যারা লাইনেও দাঁড়াতে পারছেন না আবার হাত পাততেও পারছেনা তারা পড়েছেন মহা সংকটে। খেয়ে না খেয়ে এখন সকলের একটাই জিজ্ঞাসা কবে শেষ হবে এ লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন? তবে সকলেরই বিশ্বাস একটাই যে, একদিন আলো আসবেই।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তপন কুমার ঘোষ বলেন, উপজেলায় দুস্থ মানুষের সহায়তার জন্য এ পর্যন্ত ১৫১ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লক্ষ ৯২ হাজার ৫২০ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
এছাড়া শিশু খাদ্যের জন্য ৯৪, ৫৬০ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। যা দিয়ে দুস্থ মানুষের মাঝে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া ক’টি সমাজিক সংগঠন এবং স্থানীয় সাংসদ সহ দু’একজন ব্যক্তি উদ্দোগে করোনা পরিস্থিতিতে দুস্থদের ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে।
ধানখালী ইউপি চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দীন তালুকদার’র অভিযোগ, নির্বাচনে অংশ নেয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী টিনু মৃধা টিসিবি’র ডিলার হওয়ায় পরিষদকে না জানিয়ে তিনি তার অনুসারীদের মাঝে টিসিবি’র পন্য সামগ্রী বিক্রি করেছেন। যাতে ইউনিয়নের সিংহভাগ দুস্থ মানুষ টিসিবি’র সুবিধা বঞ্চিত হয়েছে।’
এনজিও ওয়ার্ল্ড কনসার্ন এর স্থানীয় প্রতিনিধি মি: রাজিব বলেন, ’আমরা ৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। যা দিয়ে নীলগঞ্জ, মহিপুর, লতাচাপলি, বালিয়াতলী ও মিঠাগঞ্জ ৫টি ইউনিয়নে আমাদের তালিকাভুক্ত ১৫০০ দুস্থ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন গুলোতে আমাদের আত্মসহায়ক দল ও ওয়ার্ড দুর্যোগ কমিটির দুস্থ সদস্যরা এ সহায়তা পেয়েছে।’
ইউএনও আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ’ত্রান হাতে দিয়ে ছবি তোলার পর ফিরিয়ে দেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। ওয়ার্ল্ড কনসার্ন এনজিও প্রতিনিধিকে বিষয়টি ডেকে জিজ্ঞাসা করা হবে। তাদের ত্রাণ বিতরনের মাষ্টার রোল দেখে তদন্ত সাপেক্ষে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।