প্রথম নিমন্ত্রণ ॥ গল্প

কোয়েল তালুকদার
আফছার ডাকাত প্রায় ছয় মাস পর আজ তার গ্রামের বাড়িতে আসলো। বাড়িতে সবাই জানত — আফছার একটি কোস্টাল জাহাজে লোডারের চাকরি করে। কিন্তু আসলে তা নয়। সে একজন সক্রিয় ডাকাত দলের সদস্য।
বাড়িতে তার স্ত্রী কন্যা ও মা থাকে। মা বৃদ্ধা। চোখে ভালো মতো দেখতে পায় না। আবছা আবছা দেখে। সে সারাক্ষণ বারান্দায় ধারীর উপর শুয়ে বসে থাকে। ওখানেই খায়, ওখানেই ঘুমায়।
আফছারের একটি গুণ — সে নিজ জেলায় চুরি ডাকাতি করে না। সে করে ময়মনসিংহ ও সুনামগঞ্জের গ্রাম অঞ্চলে। বিশেষ করে হাওর এলাকায়।
নৌকা করে তারা ডাকাতি করে বেড়ায়। আফছারের যিনি ওস্তাদ, তার বাড়ি হচ্ছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও – এ।
আফছারের স্ত্রীর নাম মায়মুনা। সে গরীবের ঘরের মেয়ে। বাবা দিনমজুর। মায়মুনা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। খুব তাড়াতাড়ি কদম্ব ফুলের সুবাস ঝরে পড়তে থাকে তার শরীর থেকে। উষ্ণ নজর পড়ে তার দিকে। ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা স্বর্ণলতিকার মতো মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই মায়মুনার বিয়ে হয়ে যায় এই আফছার ডাকাতের সাথে।
আফছার অষ্টম শ্রেনী পাশ। সে জাহাজের একজন লোডার। মায়মুনা, তার আত্মীয় স্বজন এবং গ্রামবাসী এমনটাই জানে। আফছার জাহাজে কাম করে। এমন একটি স্বামী পেয়ে মায়মুনাও দারুণ খুশি হয়।
আফছারের মেয়েটির বয়স তিন বছর। নাম পরী। দেখতে পরীর মতো। পরীর দাদী সোহাগ করে নাতনীর নামটি রেখেছিল তাই — পরী।
আফছার বাড়িতে আসার সময় ডাকাতি করা টাকা পয়সার ভালোই ভাগ পেয়েছিল। সব মিলে হাজার সাতেক টাকা সে আনতে পেরেছিল। ট্রেন থেকে সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা স্টেশনে নেমে শহর থেকে সে অনেক কিছুই কেনাকাটা করে। মায়মুনার জন্য ভালো দেখে একটি কমলা রঙের তাঁতের শাড়ি কেনে, পরীর জন্য জামা কাপড়, জুতা, খেলনা, এবং মায়ের জন্যেও ভালো একটা পরনের কাপড় কেনে। তেল সাবান, পাউডার, স্নো, আতরও কেনে মায়মুনার জন্য।
আফছার আসার পথে যখন শৈলাভিটার খেয়াঘাট পার হচ্ছিল, সে তখন দেখতে পায় এক লোক একটি বড়ো তাজা কাতল মাছ বিক্রি করার জন্য ঘাটে বসে আছে। আফছার বাড়ির জন্য সেই মাছটিও কিনে নিয়ে আসে।
মায়মুনা অনেক খুশি। নিজের জন্য, মেয়ের জন্য, শ্বাশুড়ির জন্য নতুন কাপড় পেয়েছে। সে মহাধুম করে কাতল মাছ রান্না করে বেগুন আর নতুন আলু দিয়ে। রাতে আফছার যখন কাতল মাছ দিয়ে ভাত খাচ্ছিল তখন সে মায়মুনাকে বলছিল, তরকারি খুব স্বাদ হইয়াছে। ফাস্ট ক্লাস রাঁধিয়াছো তুমি মায়মুনা। ‘
স্বামীর এমন প্রসংসা শুনে মায়মুনা মিটিমিটি করে হাসতে থাকে। কেরোসিনের কুপীর আলোয় তার সেই মুখের হাসিটি কেউ দেখতে পায় নাই। এমনকি আফছারও না।
মায়মুনা আজ তার শ্বাশুড়িকেও খুব যত্ন করে কাতল মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়ায়। খাওয়ানোর সময় মায়মুনা শ্বাশুড়িকে বলেছিল —
‘আম্মা, আপনার ছোয়াল আপনার জন্য একখান শাড়ি কাপড় কিনে এনেছে’।
রাতে বিছানায় শোবার আগে আফছার পান মুখে দিয়ে একটি গোল্ডলীফ সিগারেট ধরায়। সিগারেট টানতে টানতে মায়মুনাকে সে বলছিল — আমি বাড়িতে থাকি না, তোমার মনে হয় খুব দুঃখ কষ্ট হয়, তাই না?
— জ্বী।
— আমার কথা মনে পড়ে?
— জ্বী, খুব পরান পোড়ে।
— আমি এবার যেয়ে কিছুদিন পরেই একেবারে বাড়িতে চলে আসব। ওখানে ঐ কাম কাজ আর ভালো লাগে না। খুব বিপদের কাজ। দরিয়া খুব উত্তাল হয়ে ওঠে। বড়ো বড়ো ঢেউ হয়। আমার শরীর কাঁপতে থাকে। তখন তোমার মুখখানির কথা খুব মনে পড়ে।
— তুমি অমন বিপদের চাকরি আর কইরো না। বাড়িতেই চইলা আইসো।
— হু। এবার চলে এসে এই গায়ে প্রয়োজনে কামালা বেইচা খাব। তাও ভালো।
— খুব খুশি হইলাম। আমার খুব ভয় করে তোমাকে ছাড়া একা একা থাকতে । তুমি কাছে থাকলে আমার কোনো ভয় লাগব না।
আফছার মায়মুনাকে জড়িয়ে ধরে। বুকের ভিতর নিয়ে বলতে থাকে — তোমার আর কখনও ভয় পেতে হবে না। আমি এমন করেই এরপর থেকে আমার বুকের মাঝে তোমাকে সারা জীবন জড়িয়ে রাখব।
আফছার সপ্তাহ খানেক বাড়িতে থাকে। সে যখন বাড়িতে আসে তখন তার ওস্তাদ মোবারক মোল্লা তাকে বলে দিয়েছিল — ‘আফছার, তুই তাড়াতাড়ি চলে আসবি। একটা ভালো দাইন আছে সামনে। তরে থাকতে হইব। ভালো ভাগ পাবি। তুই এবার বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। তরে আমি সাত দিনের ছুটি মঞ্জুর কইরা দিলাম।’
আফছার যেদিন বাড়ি থেকে চলে যাবে, তার আগেরদিন ছিল হাটবার। সে হাটে যায়। হাট থেকে খেজুর গুরের জিলাপি ও বাতাসা কেনে। হাটে ওর খাতিরা এক লোকের সাথে দেখা হয়। তার সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেশ রাত্রি হয়ে যায়।
আফছার যখন বাড়িতে ঢুকছিল সেই মুহূর্তে সে দেখতে পায় — এক যুবক মায়মুনার ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল বাড়ির অন্য দিক দিয়ে। আবছা অন্ধকারে ঐ যুবককে চিনতে পারল না — যুবকটি কে? কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন ভাবছিল সে।
হাটে যাওয়ার আগে আফছার মায়মুনাকে বলে গিয়েছিল — তুমি আজ নতুন শাড়িটি পরবে। মুখে পাউডার স্নো মাখবে। চুলে দেবে সুগন্ধি নারিকেল তেল। আর গায়ে মাখবে আতর। আফছার ঘরে যেয়ে দেখতে পেল — মায়মুনা সেজেগুজে বসে আছে। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ।
মায়মুনা আফছারকে রাতের খাবার খেতে দেয়। কিন্তু সে তেমন কিছু খেতে পারল না। মায়মুনা বলে — তুমি খাচ্ছ না যে৷!
—- কাল সকালে তোমাদের ছেড়ে চলে যাব। খুব মন খারাপ লাগছে, এইজন্য খেতে ইচ্ছে করছে না।
রাত অনেক হয়ে গিয়েছে তখন। আফছার বলছিল, তোমাকে নতুন কাপড়ে খুব ভালো লাগছে। এসো বুকের মাঝে।’
আফছার মায়মুনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে –তোমার শরীর থেকে কেমন যেন উৎকট, কেমন যেন দুর্গন্ধময় গন্ধ পাচ্ছি।
— কেন, আমি তো তোমার দেওয়া আতর মেখেছি গায়ে। সেই আতরের গন্ধ তুমি পাচ্ছ হয়ত।
— হয়ত তাই হবে। আতরের গন্ধটাই খারাপ।তোমার শরীর থেকে পাগলকরা সেই চেনা গন্ধটা পাচ্ছি না। যে গন্ধটা আমাকে মাতাল করে তোলে। আজ তোমার শরীর থেকে কেমন যেন একটা অপরিচিত গন্ধ
আসছে ।
— এমন করে বলছ যে !
— এমনি বলেছি। তোমার শরীর থেকে তোমারই সুগন্ধ পাচ্ছি। চলো না, একটু পুকুর পারে যাই। বাইরে রূপালি চাঁদের রাত। সারা বিশ্ব জমিন আজ জোছনার চাদরে ঢেকে আছে । চলো — সেই চাদরের উপর আমরা যেয়ে শুয়ে থাকি।
পরী ঘুমাচ্ছে। আফছারের মা’ও খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যা রাতেই । দরজা খুলে দুজন বেরিয়ে পড়ে। চলে যায় তারা পুকুর পারে।
সমস্ত পৃথিবী জোছনায় ডুবে আছে। কোথা থেকে যেন কাঁঠালীী চাঁপার মাতাল গন্ধ ভেসে আসছে। আফছার তার দুই হাত দিয়ে মায়মুনার দুই বাহু চেপে ধরে। এ যেন কাছে পাওয়ার প্রথম নিমন্ত্রণ। মায়মুনা আবেশে বলছিল —
‘ওগো তুমি আমাকে বুকে টেনে নাও , আমার বুক থরথর করে কাঁপছে। আফছার বলে — ”আরও কাছে আসো।’
মায়মুনা আরও নিবিড় হয়, এবং বলছিল — এই ঘাসের উপরে তুমি আমাকে শুয়ে দাও। তোমার সমস্ত ভালোবাসা এই অলৌকিক জোছনায় মেখে আমাকে আদর করো, ঢেলে দাও তোমার যত অনন্ত সুখ ।
আফছারের দুটো হাত তখন মায়মুনার গলা পর্যন্ত চলে গেছে। সে শক্ত কঠিন করে মায়মুনার গলা টিপে ধরে। তার প্রাণ নিঃস্পন্দন না হওয়া পর্যন্ত সে হাত চেপে ধরেই থাকে ।
ভোর বেলা সবাই দেখতে পায় — মায়মুনার নিথর দেহ পুকুরপারে ঘাসের উপর পড়ে আছে। শিশিরে সিক্ত হয়ে আছে তার পরনের কাপড় ও অমল দেহখানি৷ কোনো কোনো ভোর কোমল সুন্দর বিষণ্ণতারও হয়। সূর্যের কাঁচা হলুদ আলোয় মায়মুনার মুখটি রাঙাময় হয়ে উঠেছিল।
আফছার নেই। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না।
কয়েকদিন পর একটি জাতীয় দৈনিকে ছোট্ট একটি নিউজ হয় তৃতীয় পাতায় — কলমাকান্দার একটি গ্রামে ডাকাতি করতে যেয়ে গ্রামবাসীর টেঁটার আঘাতে আন্তঃ জেলা ডাকাত সর্দার মোবারক মোল্লা ও তার একান্ত সহযোগী আফছার ডাকাত সহ মোট পাঁচ ডাকাত নিহত হয়েছে। এই ঘটনায় স্থানীয় থানায় একটি মামলা রজ্জু করা হয়েছে।
৭ আগস্ট, ২০২০ ইং
মানসী কুঞ্জ, দক্ষিণখান, ঢাকা।
Print Friendly

Related Posts