আহমেদ সাব্বির রোমিও / প্রিয়াংকা ইসলাম : নতুন প্রজন্মের অনেকেরই অজানা ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছিলো উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে। তবে, বার বার ভাঙা-গড়ার খেলায় দেশে প্রথম শহীদ মিনার কোথায় হয়েছিল সেটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে যাওয়া হয়নি আজও।
বিভিন্ন স্থানের ভাষা সৈনিকদের তথ্য বলছে, প্রথম শহীদ মিনার হয়েছিল রাজশাহীতেই। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ দিবাগত রাতে রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাস সংলগ্ন এলাকায় এটি তৈরি হয়। রাজশাহীর ভাষাসৈনিকরা ওই শহীদ মিনারটিকে দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু বরাবরই সেই দাবি উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু শহীদ মিনার গড়ে উঠলেও প্রথম এই শহীদ মিনারটি বরাবরই রাষ্ট্রীয়ভাবে উপেক্ষিত থাকায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ রাজশাহীর ভাষাসৈনিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।
রাজশাহীর ভাষাসৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকার পাশাপাশি রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশের গুলিতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারসহ কয়েকজন শহীদ হন। এ খবর রাজশাহীতে এসে পৌঁছালে আন্দোলনরত ছাত্ররা সিদ্ধান্ত নেন, রাতেই রাজশাহী কলেজের হোস্টেল এলাকায় শহীদ মিনার তৈরির। যেমন কথা তেমন কাজ। সারা রাত ধরে ইট ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ভেঙে দেয় ওই শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজশাহী কলেজ ছিল এ অঞ্চলের একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই কলেজ। এই শহীদ মিনার বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসায় কয়েক বছর ধরে ভাষাসৈনিকসহ নগরীরর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছেন।
ভাষাসৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ভাষাসৈনিকদের অনেক দেরিতে হলেও মূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার দেশের এই প্রথম শহীদ মিনারটিকেও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেবে বলে প্রত্যাশা করি। ’
শহীদ মিনার তৈরির স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এই ভাষাসৈনিক বলেন, ‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি জানতে পারি, ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করেছে। খবর শুনেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাৎক্ষণিকভাবে রাজশাহী কলেজ থেকে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। সন্ধ্যায় কলেজে ছাত্ররা জরুরি সভায় মিলিত হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ঢাকায় মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতি রক্ষার জন্য রাজশাহী কলেজে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাতেই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা বিভিন্ন স্থান থেকে ইট সংগ্রহ করে। রাতে সিমেন্ট সংগ্রহ করতে না পারায় ইট ও কাদা মাটি দিয়ে তারা শহীদ মিনার নির্মাণ করে নাম দেন শহীদ ম্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভের গায়ে লিখে দেওয়া হয়, ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। ’ এ কাজে কলেজের কয়েকজন কর্মচারীও সহায়তা করেন। ’
স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শেষে ছাত্ররা তার ছবি তুলে রাখে জানিয়ে মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি বলেন, ‘রাজশাহী কলেজের শহীদ মিনারটিই বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার। আমরা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি সারারাত জেগে পাহারা দিই। কিন্তু পরদিন সকালে যখন আমরা সেখান থেকে চলে যাই, সেই সুযোগে ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। ’
রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা এই শহীদ মিনারটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন কয়েকবার। এ নিয়ে তিনি কয়েক দফা জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিলেও কোনো ফল আসেনি। ভাষাসৈনিক ও রাজশাহীর সাধারণ মানুষের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজশাহী কলেজ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এবং সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশার সহায়তায় মুসলিম হোস্টেলের গেটের কাছে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সেই স্থানটিতে ২০০৯ সালে একটি ফলক নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সেটিও এখন উপেক্ষিত। সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এ স্থানটিতে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৫ সালে। সেই শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার কাজ গত বছরের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা এখনো অসমাপ্ত।
প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মহা. হবিবুর রহমান। একটা সময় তিনি গনমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি, এটি আমাদের রাজশাহীবাসীর ব্যর্থতা। আমাদের যারা ভাষাসৈনিক ছিলেন তাদের মধ্যকার অনেকেই পরলোক গমন করেছেন। দু-একজন এখনো বেঁচে আছেন। তারপরও শহীদ মিনারটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। আমাদের রাজশাহীর শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিবীদ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী যারা আছেন তারা যে যৌথ প্রয়াস নিয়ে এগোবেন, সেটা কখনো হয়ে ওঠেনি। ’
তিনি আরও বলেন, ‘এই শহীদ মিনারটি কেন্দ্রের (ঢাকা) বাইরে হওয়ায় স্বীকৃতি না পাওয়ার অন্যতম একটি কারণ। শহীদ মিনারটি ঢাকায় হলে দেখা যেত যে বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটি গঠন হতো। এটার সঠিকতা যাচাই করা হতো। আমরাও কিন্তু সেটিই মনে করছি। আমরা অযৌক্তিক দাবি করছি না। এই রক্ত ঝরা মাসে এটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক এটিই আমরা চাই। অন্তত রাজশাহীবাসীর দাবির সঠিকতা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হোক। ’ ভাষা শহীদদের স্মরণে রাজশাহীতেই দেশের প্রথম শহীদ মিনারটি তৈরি হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন,এখনো তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন রাজশাহীতে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি দেশের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে এটিকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হোক। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনে রাজশাহী কলেজ শহীদ ছাত্রসহ ভাষা আন্দলোনে শহীদদের স্মরণে এ শহীদ মিনার নতুনভাবে নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন রাজশাহী সদর আসনের সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা।
অপর দিকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভাঙা-গড়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে মরহুম অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন , ‘ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দারকে দিয়ে ডিজাইন করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কারণ, স্মৃতিস্তম্ভের বিষয়টি বদরুল ছেলেবেলায় তার বাবার কাছে শুনেছিল। তারই আদলে ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে তিনি একটা নকশা করে দেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের নির্মাণ শেষ হলে ২৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনার এর উদ্বোধন করেছিলেন ভাষা শহীদ সফিউর রহমানের বাবা।’ যদিও ততক্ষণে রাজশাহীর শহীদ মিনার তৈরি হয়ে সেটা ভেঙেও ফেলা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চলার পর রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্ররা রাতের আঁধারে লণ্ঠন জ্বালিয়ে কলেজ হোস্টেলের মাঠে কাদা দিয়ে ইট গেঁথে বানিয়েছিলেন প্রথম শহীদ মিনার।পরের দিন পুলিশ এসে তা ভেঙে দেয়।
একুশে পদক প্রাপ্ত মরহুম লেখক ও সাংবাদিক সাঈদ উদ্দিন আহমদ এর লেখা থেকে জানা যায়, রাজশাহী মেডিক্যাল স্কুলের সিনিয়র ছাত্র এস এম গাফ্ফারের সভাপতিত্বে সভায় দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। তার মধ্যে শহীদ ছাত্রদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ করাটাও একটা। ইট ও কাদামাটি দিয়ে যেভাবেই হোক রাতেই শহীদদের স্মরণে একটি শহীদ মিনার তৈরি করতে হবে বলে সবাই সিদ্ধান্ত নিলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন রাজশাহী কলেজের সিনিয়র ছাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোলাম আরিফ টিপু ( মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর)। ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার সেই রাতের সিদ্ধান্তে একদিনের মধ্যে তৈরি হলো মিনার, লেখা হলো ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। আর দেয়ালে সেঁটে দেওয়া হলো একটি চরণ-‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই। নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান,ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’সেখানে উপস্থিত গোলাম আরিফ টিপু বলেন, কোথা থেকে একটা ভাঙাচোরা ক্যামেরা এনে সেইদিন ছবিও তুলে রাখা হয়েছিল। এদিকে আমরা সারা রাত জেগে শহীদ মিনারটি নির্মাণ করি। পরদিন সকালে হরতালের পিকেটিং করার জন্য আমরা সবাই হোস্টেল থেকে বেরিয়ে পড়ি। এ সময় পুলিশ এসে শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলে। আমরা খবর পেয়ে বিকেলে এসে দেখি, পুলিশ শহীদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
২০১৩ সালে জীবিত থাকা কালে এই ভাষা সৈনিককে প্রথম শহীদ মিনারের স্মৃতি নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে গনমাধ্যমকে তিনি আরও বলেন, কে আগে আর কে পরে এটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না, তবে এটা সত্য রাজশাহী কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে আমরা একদিনেই শহীদ মিনার তৈরি করে ফেলি। সিদ্ধান্তটা ২১ তারিখেই ছিল।এটাই যে প্রথম শহীদ মিনার সেটা প্রমাণে আমরা কখনও আর এগোয়নি।কিন্তু সঠিকটা জানানোর জন্য ইতিহাসের কিছু দায় থাকে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, অবশ্যই ইতিহাসের দায় আছে এবং এটাই সত্য যে, সময়ের হিসাব করলে রাজশাহীর শহীদ মিনারটি আগে হয়েছিল। উল্লেখ্য, ভাষাসৈনিক সাঈদ হায়দার ২০১৪ সালের ভাষার মাসের ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।