শাহ মতিন টিপু: ভাষা ও স্বাধীনতা একই সুতোয় গাঁথা। ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরেই জ্বলে উঠেছিল স্বাধীনতার আন্দোলনের আগুন। ভাষার মাস শেষ হতেই এলো স্বাধীনতার মাস। আগুন ঝরানো মার্চের প্রথম দিন আজ।
স্বাধীনতার মাস মার্চ এবার এসেছে ভিন্ন বার্তা নিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর এ মাসেই পূর্ণ হচ্ছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত মুজিব বর্ষ ঘোষণা করা হলেও পরে সময় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর সাথে যোগ হয়েছে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চুড়ান্ত সুপারিশ। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ প্রাপ্তি বিরাট অর্জন। করোনা আবহ বিবেচনায় নিয়ে রাষ্ট্রীয়, সরকারি ও বেসরকরি পর্যায়ে এ মাসে অনুষ্ঠিত হবে নানা অনুষ্ঠান।
একাত্তরের মার্চ ছিল মুক্তিকামী কোটি জনতার আন্দোলনে উত্তাল। সেদিন ঢাকা ছিল স্লোগানের। ‘জাগো জাগো, বাঙালী জাগো’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালী বাঙালী’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো-সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এমন হাজারো স্লোগানে উত্তাল ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১ মার্চ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে কোন আলোচনা ছাড়া প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একতরফা ঘোষণায় তাৎক্ষণিকভাবে বাংলার মানুষ ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে ছাত্ররা বের হয়ে আসেন। ঘর থেকে জনতা ছুটে আসেন রাজপথে, পল্টন ময়দান হয়ে ওঠে জনসমুদ্র। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরাও খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। হোটেল পূর্বাণীর চারদিকে জনস্রোত। ঢাকা শহরজুড়ে শুধুই স্লোগানের ধ্বনি। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচী ঘোষণার দাবি জানায়। আর কোন আলোচনা নয়, পাক হানাদারদের সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি ক্রমশ বেগবান হতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন এবং ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু জানিয়ে দেন, ‘বিনা চ্যালেঞ্জে আমি কোন কিছুই ছাড়ব না। ছয় দফার প্রশ্নে আপোস করব না। দুই থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।’
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ঐ ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যার হাতে যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেন। শত্রুর মোকাবিলা করার দৃপ্ত আহবানও ভেসে আসে তাঁর বজ্রকণ্ঠে। এ ভাষণেই বাঙালি পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল। দেশের কৃষক-শ্রমিক, পেশাজীবী, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সেদিন এই একটি কণ্ঠের আহবানে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
এরই মধ্যে নানা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে।
এভাবেই আসে ২৫ মার্চ কালরাত্রি। পাক হানাদার বাহিনী ভারি অস্ত্র, কামান নিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গর্জে ওঠে গোটা জাতি।
শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অগ্নিঝরা দিন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে জাতি লাভ করে স্বাধীনতা।