স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ চূড়ান্তভাবে একটি জাতিকে মুক্তির লড়াইয়ে নামিয়ে দেওয়ার দিন। ৭ মার্চ স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার চূড়ান্ত আহবান।

দেশজুড়ে সেদিন সবারই মনে একটিই জল্পনা-কল্পনা, বাঙালীর মুক্তির দিশারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে কী বলবেন? তার বর্জকন্ঠে কি উচ্চারিত হবে? সারা দেশের মানুষ অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে পরবর্তী দিকনির্দেশনা জানার।

রেসকোর্স ময়দানের (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মঞ্চ ঘিরে সেদিন সকাল থেকেই বিক্ষুব্ধ বাংলার সংগ্রামী জনতা এক স্রোতে এসে মিশেছিল। সেদিন ছিল রোববার। সকাল থেকেই সারাদেশের জনস্রোত এসে মিলিত হতে থাকে রেসকোর্স ময়দানে।

সারাদেশ থেকে ছুটে আসা মানুষের ঢলে রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে রীতিমত জনবিস্ফোরণ ঘটে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকেই মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ক্ষমতা হারায় সেদিনের রেসকোর্স।

রাজধানী ঢাকার চারদিকে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা রক্তচক্ষু নিয়ে প্রহরায়। আকাশে উড়ছে হানাদারদের যুদ্ধ জঙ্গী বিমান।

মুক্তিপাগল বাঙালির সেদিকে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ নেই। তাদের শুধু অপেক্ষা তাদের প্রিয় নেতা কখন আসবেন।

গণমানুষের স্লোগানের মধ্য দিয়ে বিকেল তিনটা ২০ মিনিটে জনসমুদ্রের মঞ্চে আসেন স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার ওপর। আকাশ কাঁপিয়ে স্লোগান চলছে, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’।

বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতকাটা কালো কোট পরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রাণপুরুষ দৃপ্তপায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। আকাশ কাঁপানো স্লোগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু করলেন ভাষণ।

মঞ্চে দাঁড়িয়েই বিশাল জনসমুদ্রে পাকিস্তানের নিষ্পেষণ থেকে বাঙালীর মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে বাঙালী জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। মাত্র ১৯ মিনিটের স্বল্প সময়ে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাসই তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের জানিয়ে দেন, স্বাধীনতাকামী জনতাকে আর বুলেট-বেয়নেটে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

বর্জ্রকণ্ঠে রেসকোর্সের মাঠে তিনি আবৃত্তি করেন বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্ল­াহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে ওঠে মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে ওঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র।

সেদিন বেতারে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি প্রচারের কথা থাকলেও তা করেনি পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা। কিন্তু মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে শেখ মুজিবের নির্দেশ। তবে পরদিন ৮ মার্চ বীর বাঙালিদের চাপে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি রেডিওতে প্রচারে বাধ্য হয় তারা।

এদিকে এদিন বঙ্গবন্ধু ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা যাতে না দেন, তার জন্য মার্কিন সরকার তৎপর হয়। ৭ মার্চ সকালে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে সাক্ষাত করেন। স্বল্প সময়ের এ বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পরিষ্কার ভাষায় ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানান। তিনি বলেন- ‘পূর্ববাংলায় স্বঘোষিত স্বাধীনতা হলে যুক্তরাষ্ট্র তা সমর্থন করবে না।’

মার্কিন কূটনীতিকের ভাষা এবং পাক সামরিক জান্তাদের পরিকল্পনার কথার আঁচ পান বঙ্গবন্ধু। তাই বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে মার্কিন ও পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন বীর বাঙালীকে।

১১০৮টি শব্দ সম্বলিত প্রায় ১৯ মিনিটের এই বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন বাঙালী জাতি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। সে নির্দেশ বুকে ধারণ করেই আজ আমাদের বাংলাদেশ।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts