বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ আজ পবিত্র শবে বরাত। হিজরি সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতটি মুসলমানরা সৌভাগ্যের রজনী হিসেবে পালন করে। এই মর্যাদাপূর্ণ রাতে মহান আল্লাহ বান্দাদের জন্য তার রহমতের দরজা খুলে দেন।
‘শবে বরাত’ হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত এক বরকতময় সুবর্ণ সুযোগ। পবিত্র শবে বরাতের অর্থ হচ্ছে ভাগ্য রজনী। এই রাতে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ মুমিনদের ওপর বর্ষিত হয়।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতে এ রাতটি শবেবরাত হিসেবে অধিক পরিচিত। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, ইরান ও ভারতীয় উপমহাদেশে এ মাসের একটি রজনীকে ‘শব-ই-বরাত’ বলা হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো কোনো দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে শবেবরাত ভিন্ন নামে পরিচিত। আরব বিশ্বের মানুষ এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বলেন।
হিজরি সালের শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতটিই হচ্ছে মহিমান্বিত এই পবিত্র শবেবরাত। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এই রাতটি বিশেষভাবে তাৎপর্যমণ্ডিত।
পবিত্র কোরআন শরীফ-এর ভাষায় ‘শবে বরাতকে’ ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ বা বরকতময় রজনী’ এবং হাদীস শরীফ-এর ভাষায় শবে বরাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান বা শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাসূল (সা.) এর হাদিসে এবং আলেম-ওলামা ও তাফসীরকারকদের বর্ণনায় শবেবরাতের বহু তাৎপর্য এবং এ রাতের মহিমার কথা উল্লেখ করেছেন।
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত. মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, যখন শা’বানের ১৫ তারিখ রাত্রি উপস্থিত হবে তখন তোমরা উক্ত রাতে নামায আদায় করবে এবং দিনে রোযা রাখবে। কেননা নিশ্চয়ই আল্লাহপাক উক্ত রাত্রিতে সূর্যাস্তের সময় পৃথিবীর আকাশে আসেন অর্থাৎ রহমতে খাস নাযিল করেন।
অতঃপর ঘোষণা করেন, ‘কোনো ক্ষমা প্র্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোনো রিযিক প্রার্থনাকারী আছো কি? আমি তাকে রিযিক দান করব। কোনো মুসিবতগ্রস্ত ব্যক্তি আছো কি? আমি তার মুসিবত দূর করে দেব। এভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষণা করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
হাদীসে আরো এসেছে, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন- এক রাতে রাসূল (সা.) কে না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম। খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে আমি তাকে দেখতে পেলাম। মহানবী (সা.) বললেন- কি ব্যাপার আয়েশা? তোমার কি মনে হয় আল্লাহ এবং তার রাসূল তোমার উপর কোনো অবিচার করবেন? হযরত আয়েশা (রা.) বললেন- আমার ধারণা হয়েছিল আপনি অন্য কোন বিবির ঘরে গিয়েছেন। রাসূল (সা.) তখন বললেন- যখন শাবান মাসের ১৫তম রাত আসে তখন আল্লাহ পাক এ রাতে প্রথম আসমানে নেমে আসেন। তারপর বনু কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে বেশি সংখ্যক বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেন। (সুনানে তিরমিযী)
মহানবী (সা.) আরো বলেন- রজব আল্লাহর মাস,শাবান আমার মাস, আর রমযান আল্লাহর সকল বান্দাদের মাস। (মা‘সাবাতা বিস সুন্নাহ)
যে পাঁচটি রাতে বিশেষভাবে দোয়া কবুল হওয়ার ওয়াদা করা হয়েছে তার মধ্যে শবে বরাতের রাত একটি, মহা নবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই পাঁচ রাত্রিতে দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে থাকে। (১) রজব মাসের প্রথম রাতে, (২) শবে বরাতের রাতে, (৩) ক্বদরের রাতে, (৪) ঈদুল ফিতরের রাতে, (৫) ঈদুল আযহার রাতে।’ (মা-ছাবাতা বিসসুন্নাহ)
শবেবরাতের এ রাতটিকে পবিত্র রমজানুল মোবারকের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে যেন রমজানের অভ্যর্থনার জন্যই রাখা হয়েছে। মাত্র দুই সপ্তাহ পর যে রহমত, মাগফিরাত ও মুক্তির মহান মাস আসন্ন, তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য এ শবে বরাত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র রমজানের মাধ্যমে তার যে রহমতের দ্বার খুলে দেবেন, তার আগে একটি রাত রেখেছেন।
রাসুলে আকরাম (সা.) এর হাদিস অনুযায়ী, শবেবরাত উপলক্ষে করণীয় দুটি। এক. রাত জেগে ইবাদত-বন্দেগি করা। যেমন নফল নামাজ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দুরুদ, তওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি। দুই. পরদিন রোজা রাখা। এমনিতে সারা শাবান মাসেই অধিকহারে রোজা রাখা উত্তম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রায় সারা শাবান মাসেই রোজা রাখতেন।
শবে বরাতের রজনীর ইবাদতের ফজিলত ও তাৎপর্য বিষয়ে নির্দেশনা-ইঙ্গিত পাওয়া যায় এমন আরেকটি হাদিস হচ্ছে- আলা ইবনুল হারিস (রহ.) থেকে বর্ণিত, হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সেজদা করেন যে, আমার ধারণা হল তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি তখন উঠে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল। যখন তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করলেন তখন আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়েশা! অথবা বলেছেন, ও হুমাইরা, তোমার কি এই আশঙ্কা হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি উত্তরে বললাম, না, ইয়া রাসূলুল্লাহ। আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার এই আশঙ্কা হয়েছিল, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কিনা। নবিজি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন ইরশাদ করলেন, ‘এটা হল অর্ধ শাবানের রাত। আল্লাহতাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে তার বান্দার প্রতি মনযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের ছেড়ে দেন তাদের অবস্থাতেই। (বাইহাকি)
শবে বরাত পালন বলতে আতশবাজি করা, হালুয়া-রুটির আয়োজন করা, বিশেষ পদ্ধতির নামায পড়াকে জরুরি মনে করা, এ রাতে গোসল করা ফযিলতপূর্ণ মনে করা, এ রাতে মসজিদে গিয়েই ইবাদত করাটা বাধ্যতামূলক মনে করা ইত্যাদি বিদআত। এসব করা জায়েজ নয়। পবিত্র শাবান মাস ও শবেবরাত অধিক ইবাদতের উর্বর মৌসুম। শবেবরাত কোনো আনন্দ-উৎসবের সময় নয়। উৎসব প্রবণতায় শাবান ও শবেবরাতের প্রকৃত আবেদন এবং পবিত্রতা নষ্ট হয়।