রপ্তানি আয়ের ৬৭.২১ শতাংশই ওয়ালটনের
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশে তৈরি কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স পণ্যের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, উচ্চ গুণগতমান ও সাশ্রয়ী মূল্য জয় করে নিচ্ছে বিশ্ব ক্রেতাদের আস্থা। ইউরোপসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ ট্যাগযুক্ত ইলেকট্রনিক্স পণ্যের নতুন রপ্তানি বাজার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানিতে এসেছে দুর্দান্ত সাফল্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই’২০-মার্চ’২১) ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানির পরিমান আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় সাড়ে আট গুণ বেড়ে ১২.৩৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। মোট রপ্তানির প্রায় ৬৭.২১ শতাংশ আয় এককভাবে অর্জন করেছে দেশের ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি’র তথ্যমতে, বাংলাদেশের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানি তালিকায় রয়েছে রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এলইডি টেলিভিশন, এয়ার কন্ডিশনার, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার, রাইসকুকার, গ্যাস স্টোভ, ইন্ডাকশন কুকার, ফ্যান, হট প্লেট, রেফ্রিজারেটর কম্প্রেসর ও কম্প্রেসরর তৈরির যন্ত্রাংশ।
ইপিবি’র প্রকাশিত পণ্য ভিত্তিক তথ্যানুসারে, গত জুলাই থেকে মার্চ’২১ পর্যন্ত সময়ে দেশের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২২ লাখ বা ১২.২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) একই সময়ে এ খাতের রপ্তানি আয়ের পরিমান ছিল প্রায় ১৪ লাখ ৩৮ হাজার বা ১.৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে দেশের ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্যে রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে আট গুণ।
খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারের কাছ থেকে রপ্তানি প্রণোদনা ও অন্যান্য নীতি সহায়তা পেলে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ইন্ডাস্ট্রিজ পোশাক শিল্পের মতো আরেকটি বড় রপ্তানি খাত হয়ে উঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতোমধ্যে স্থানীয় বাজারে বিদেশী ব্র্যান্ডের দৌরাত্ম্য দূর করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নিজেদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডগুলো সামর্থ্যরে প্রমাণ দেখিয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ব কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স বাজারে নেতৃত্ব দেয়ার যথেষ্ট সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় বেশিরভাগ গ্লোবাল ব্র্যান্ড এখন অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনের দিকে ঝুকছে। এই সুযোগ লুফে নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ব কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাব হয়ে উঠার ব্যাপক সামর্থ্য রয়েছে।
ইপিবি’র তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইলেনকট্রনিক্স খাতের রপ্তানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি এই শিল্পকে সম্ভাবনাময় নতুন রপ্তানি খাত করে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে দেশের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন। চলতি অর্থবছরে জুলাই’২০ থেকে মার্চ’২১, এই ৯ মাসে ৮.৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য রপ্তানি করেছে ওয়ালটন। যা মোট রপ্তানির প্রায় ৬৭.২১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ওয়ালটন রপ্তানি করেছে প্রায় ১৮ লাখ ৩৬ হাজার মার্কিন ডলারের রেফ্রিজারেটর, প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের ফ্রিজার, প্রায় ১৭ লাখ ৬ হাজার মার্কিন ডলারের এয়ার কন্ডিশনার, প্রায় ৩৮ লাখ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের এলইডি টেলিভিশন, প্রায় ৬ লাখ ৬৬ হাজার মার্কিন ডলারের রেফ্রিজারেটর কম্প্রেসর ও আনুষঙ্গিক যন্ত্র্যাংশ, প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার মার্কিন ডলারের ওয়াশিং মেশিন, প্রায় ১০ হাজার ২৬৬ মার্কিন ডলারের ব্লেন্ডার, প্রায় ৩৭ হাজার ৮’শ মার্কিন ডলার মূল্যের গ্যাস স্টোভ, প্রায় ২৭ হাজার ৮’শ মার্কিন ডলারের রাইস কুকার, ৪ হাজার ৪’শ মার্কিন ডলারের ইন্ডাকশন কুকার, ১৭ হাজার ৬’শ ডলারের ফ্যান, ২ হাজার ২’শ ডলারের হট প্লেট।
সূত্রমতে, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশী ইলেকট্রনিক্স পণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জন করেছে ওয়ালটন। ইউরোপের জার্মানি, গ্রিস, আয়ারল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, স্পেন, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালির মতো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ওয়ালটন পণ্যের নতুন রপ্তানি বাজার তৈরি হয়েছে। ফলে, চলতি অর্থবছরে জুলাই’২০ থেকে এপ্রিল’২১ পর্যন্ত, এই ১০ মাসে ওয়ালটনের পণ্য রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় নয় গুণ বেড়ে ১০.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাড়িয়েছে। এদিকে এ বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে প্রায় ৭.৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে ওয়ালটন। আগের বছরের একই সময়ে তাদের রপ্তানির পরিমান ছিল মাত্র ০.৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ওয়ালটনের মতো দেশের অন্য ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও রপ্তানি বাণিজ্যে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার আহবান জানিয়েছেন ইপিবি’র ভাইস-চেয়ারম্যান এ.এইচ.এম আহসান। তিনি বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশী কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্সের সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে। বিশ্ববাজরে প্রতিযোগি মূল্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও উচ্চ গুণগতমান পণ্য দেয়ার যথেষ্ট সামর্থ্যও রয়েছে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স ব্র্যান্ডের। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বাজারে শতভাগ সফলতা পেতে বৈশ্বিক বাজার বিশ্লেষন, ক্রেতা গবেষণা ও পারস্পরিক ব্যবসায়িক যোগাযোগ স্থাপনের প্রতি বিশেষ জোর দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশীয় ইলেকট্রনিক্স পণ্যের রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ ও নতুন বাজার সৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী গোলাম মুর্শেদ বলেন, কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্সের আন্তর্জাতিক বাজারকে টার্গেট করে ওয়ালটন নিয়েছে ‘ভিশন ২০৩০’। অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা গ্লোবাল ব্র্যান্ড হয়ে উঠবে ওয়ালটন। লক্ষ্য পূরণে দীর্ঘ ও স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনার সমন্বয়ে তৈরি করা হয়েছে রোডম্যাপ। এরই অংশ হিসেবে ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি ১২ মিলিয়ন থেকে ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করা এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স রপ্তানির টার্গেট। নিজস্ব ব্র্যান্ড বিজনেস বাড়ানোর পাশাপাশি ওইএম (অরিজিনাল ইক্যুইপমেন্ট ম্যানফ্যাকচারার) হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্র্যান্ডের নামে পণ্য তৈরির মাধ্যমেও রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ করছে ওয়ালটন।
ওয়ালটন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজের ডিরেক্টর নিশাত তাসনিম শুচি জানান, পণ্যের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, দীর্ঘস্থায়িত্ব, প্রতিযোগি মূল্য ও যুগোপযোগি ডিজাইন- আন্তর্জাতিক বাজার প্রতিযোগী সক্ষমতার এই মৌলিক বিষয়গুলোতে যেকোনো ব্র্যান্ডের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশী ব্র্যান্ড ওয়ালটন। ফলে ওয়ালটনের তৈরি ফ্রিজ, টিভি, এসি, কম্প্রেসর, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদি প্রযুক্তি পণ্যে অল্প সময়ের মধ্যে জয় করে নিচ্ছে বিশ্ব ক্রেতাদের আস্থা। যার প্রেক্ষিতে কোভিড-১৯ এর ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশে ওয়ালটন পণ্যের রপ্তানি বাজার বেড়েছে।
জানা গেছে, একসময় স্থানীয় চাহিদা মিটাতে এসব পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। তবে ২০০৮ সালে ওয়ালটন স্থানীয়ভাবে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদন শুরুর পর বাজারের চিত্র দ্রুত পাল্টে যায়। কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওয়ালটনের পাশাপাশি এ খাতে গড়ে উঠে মিনিস্টার, যমুনা, আরএফএলসহ কয়েকটি দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান।
বর্তমানে স্থানীয় বাজারে ইলেকট্রনিক্স, ইলেকট্রিক্যাল ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের চাহিদার ৯০ ভাগেরও বেশি পূরণ করছে দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো। এদের মধ্যে ফ্রিজের প্রায় ৭৫ ভাগ মার্কেট শেয়ার এখন ওয়ালটনের। পাশাপাশি টেলিভিশনের প্রায় ৫০ শতাংশ বাজার এবং এককভারে এসির চাহিদা পূরণেও ওয়ালটন শীর্ষে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রায় ৪০টি দেশে কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্স ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স পণ্য রপ্তানি করছে ওয়ালটন। #