বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে সরকার অষ্টম পঞ্চ-বার্ষিকী পরিকল্পনাতেও তামাক নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে ৩ জুন সন্ধ্যায় ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টর আয়োজিত ‘বাজেটে তামাক কর ও আমাদের প্রতিক্রিয়া’ শীর্ষক বাজেট ২০২১-২২ ঘোষণা পরবর্তী ভার্চুয়াল লাইভ আলোচনায় জাতীয় সংসদে ঘোষিত প্রস্তাবিত বাজেট প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায় বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সরকারের সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, অধ্যাপক ড. রুমানা হক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কনভেনর, বিএনটিটিপি, সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কারিগরি পরামর্শক, দি ইউনিয়ন, সুশান্ত সিনহা, বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন এবং আতাউর রহমান মাসুদ, সিনিয়র পলিসি এডভাইজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস। আলোচনার শুরুতে মূল প্রবন্ধে উপস্থাপন করেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের প্রকল্প সমন্বয়কারী মোঃ শরিফুল ইসলাম।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সরকারের সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলেন, আমার কাছে মনে হয়, নীতিনির্ধারকদের কাছে তামাক করের বিষয়টা স্পষ্ট নয়। ফলে প্রতি বছরই আশাব্যঞ্জক ভাবে তামাকের উপর কর বৃদ্ধি পায় না। আমি আশা করবো আগামীতে নীতিনির্ধারকদের কাছে তামাক কর বৃদ্ধির বিষয়ে আমাদের অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে পারবো।
ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ বলেন, বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো এবারের বাজেটে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়ে যাচ্ছে বরাবরের মতোই। স্তর সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখায় ভোক্তার সিগারেট স্তর পরিবর্তনের সুযোগ থেকে যাবে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম স্তরে সিগারেটের দাম না বাড়ায় ৭২% ভোক্তা যারা নিম্ন আয়ের মানুষে মধ্যে ধূমপানের প্রবণতার কোনো পরিবর্তন হবে না বরং তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আরো বেড়ে গেল। একই সাথে ধূমপান শুরু করতে পারে এমন তরুন প্রজন্মকে ধূমপানে নিরুৎসাহিত করা যাবে না।
অধ্যাপক ড. নাসির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বলেন, তামাক শিল্প বান্ধব বাজেট হিসেবেই এটিকে আমি অভিহিত করবো। কারণ তামাকবিরোধীদের দাবি অনুযায়ী সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি এবং সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর আকারে আরোপ না করায় সরকার ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলোর আয় বৃদ্ধি পাবে ফলে তারা মৃত্যুবিপণনে আরো উৎসাহিত হবে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
অধ্যাপক ড. রুমানা হক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কনভেনর, বিএনটিটিপি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন ও মধ্যম স্তরে দাম ও সম্পূরক শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরে খুবই সামান্য পরিমানে দাম বাড়ানো হয়েছে যা অত্যন্ত্ হতাশাব্যঞ্জক। উচ্চ এবং প্রিমিয়াম স্তরে যথাক্রমে প্রতি ১০ শলাকা ৫ টাকা ও ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। যার অর্থ দাড়ায় শলাকা প্রতি দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৫০ পয়সা ও ৭০ পয়সা। মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এ মূল্যবৃদ্ধি হতাশাজনক। এতে ভোক্তাদের সিগারেটে কোনভাবেই নিরুৎসাহিত করবে না। এছাড়া প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২০ টাকায় অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। ধোয়াঁবিহীন তামাক ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে এই পদক্ষেপ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম, কারিগরি পরামর্শক, দি ইউনিয়ন বলেন, এবারের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী তামাকের ব্যবহার কমানো ও রাজস্ব বৃদ্ধিও কথা বলেছেন। তবে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে কোনো কার্যকর উদ্যোগ প্রস্তাবিত বাজেটে নেই। সরকার এবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বিড়ির মূল্যের কোন পরিবর্তন করে নি। ফলে বিড়ির প্রধান ভোক্তা নিম্ন ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিড়ির ব্যবহার আরও বেড়ে যাবে। এতে করে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। অন্যদিকে, টানা ষষ্ঠ বছরের মত বিড়ির সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশে বহাল রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে জনস্বাস্থ্যবিরোধী।
আতাউর রহমান মাসুদ, সিনিয়র পলিসি এডভাইজার, ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণে আমাদেরকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ কতটা জরুরি। তবে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তামাকপণ্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রস্তাবিত বাজেটে কার্যকর কর ও মূল্য বৃদ্ধির পদক্ষেপ উপেক্ষা করা হয়েছে। বিশেষ কওে সরকারের সুযোগ ছিল তামাক-কর বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব আয়ের, যা করোনাকালীন সময়ে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় করা যেত। তামাকের ব্যবহার কমানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে তামাকপণ্যের মূল্য বাড়ানো। উচ্চ মূল্য তরুণদের তামাক ব্যবহার শুরু নিরুৎসাহিত করে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীদেরকে তামাক ছাড়তে উৎসাহিত করে। রিভিশন বাজেটে তামাক-কর বৃদ্ধি করা হবে সে প্রত্যাশাই সকলের।
এছাড়াও আলোচনায় বক্তব্য প্রদান করেন ন্যাশনাল হার্ড ফাউন্ডেশন এর ডিপার্টমেন্ট অব ইপিডেমিউলজি এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী তাবিনাজের সমন্বয়কারী সাইদা আখতার, প্রত্যাশা মাদক বিরোধী সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি হেলাল আহমেদ, বিসিসিপির টিম লিডার মোহাম্মদ শামীমুল ইসলাম প্রমুখ।