বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ অতিমাত্রার ভূমিকম্প ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। কারণ ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মিজ- ওই তিন গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। এর মধ্য ইন্ডিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত সিলেট, যার উত্তরে ডাউকি ফল্ট। ওই প্লেটগুলো সক্রিয় থাকায় এবং পরস্পর পরস্পরের দিকে ধাবমান হওয়ায় এখানে প্রচুর শক্তি জমা হচ্ছে। আর জমে থাকা ওসব শক্তি যে কোনো সময় ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে। যেজন্য বাংলাদেশ অতিমাত্রায় ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। ভূতত্ত্ববিদদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিভাগীয় শহর সিলেট ভূমিকম্পে অতি সম্প্রতি দফায় দফায় কেঁপে ওঠেছে। এ অবস্থাকে বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস মনে করছেন। মূলত ডাউকি ফল্ট ও সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে গত ৫শ থেকে এক হাজার বছরে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের উৎপত্তি না হওয়ায় সিলেটের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোকে বড় ধরনের ভূমিকম্পের পূর্বাভাস বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ওই মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে প্রায় এক থেকে দুই লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। এমন পরিস্থিতিতে জরুরি ভিত্তিতে ভবনগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ভূমিকম্পের কারণে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি ও ঝুঁকি কমাতে সচেতনতা মহড়া বাড়ানোর ওপর বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বারোপ করেছেন।
প্রকৌশলীদের মতে, দেশে মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জায়গার স্ট্রাকচার নষ্ট হয়ে যাবে। কারণ বেশিরভাগ স্ট্রাকচার ৭ মাত্রার বেশি ভূমিকম্পের প্রেসার নিতে পারবে না। বিশ্বের অধিকাংশ ভূমিকম্পে ভবন চাপা পড়ে অধিকাংশ মানুষ মার গেছে। এদেশেও বিল্ডিংগুলো ভালো অবস্থাতে নেই। আর ঢাকাতে বিগত ২০১৫-১৬ সালে বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের বিষয়ে এক গবেষণায় এক থেকে দুই লাখ লোক হতাহত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। কারণ ঢাকায় লোক অনেক বাসায়। ঢাকায় বাসা-বাড়ি আছে ২১ লাখ, চট্টগ্রামে আছে ৫-৬ লাখ আর সিলেটে আছে এক লাখ। ঢাকার বাড়িঘরের মধ্যে খুব কমই ভূমিকম্প সহনশীলতা রয়েছে। তার মধ্যে ৩ হাজার বিল্ডিং হয়তোবা কিছুটা ভালো। কারণ সেগুলো বড়। আর বড় বিল্ডিং করার সময় মানুষ সতর্ক থাকে। এর মানে সেগুলো বাদে সব বিল্ডিংই যে ভেঙে পড়বে তা নয়। তবে সেগুলো চেক করতে হয়। সাভারের প্লাজা ধসের পর ৫ হাজার ফ্যাক্টরি চেক করে ৩৫ ভাগই খারাপ পাওয়া গিয়েছিল।
এদিকে ভূমিকম্প প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থ অবজারভেটরির পরিচালক ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, হবিগঞ্জ অঞ্চলে ১৯২২ সালে ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল; ১৯১৮ সালেও ৭.৫ মাত্রার হয়েছিল। ৪ বছরের ব্যবধানে বড় ভূকম্পন ছিল শত বছর আগে। এক মাস আগে ডাউকি ফল্টের উত্তর প্রান্তে আসাম সীমান্তে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। তার মানে ডাউকি ফল্ট খুব সক্রিয়। ডাউকি ফল্ট ও টেকনাফ সাবডাকশন জোনে হাজার বছর ধরে যে পরিমাণ শক্তি ক্রমান্বয়ে সঞ্চয় হয়ে আসছে, তাতে ৮ মাত্রার অধিক ভূকম্পন হতে পারে। এ শক্তি একবারেও বের হতে পারে; আবার আংশিকও বের হতে পারে। সেজন্য দেশবাসী ঝুঁকি মুখেও রয়েছে। এ কারণে মানসিক প্রস্তুতি দরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অনেক বছর আগে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এটা চলমান রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা- মহড়া প্রতি বছরই করতে হবে। করোনায় যেমন মাস্ক আবশ্যক, ভূমিকম্পের সচেতনতায় মহড়াও তেমন আবশ্যক। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট সিটির মেয়ররা মহড়া আয়োজনের ব্যবস্থা করতে পারে। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবকদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
অন্যদিকে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসের করণীয়ের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. জিল্লুর রহমান জানান, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস করার জন্য বিল্ডিং কোড মেনে সঠিক গ্রাউন্ড মোশন নিয়ে বিল্ডিং ডিজাইন করতে হবে। সঠিক গ্রাউন্ড মোশন ধরে বিল্ডিং ডিজাইন করলে বিল্ডিং পড়বে না। একেবারেই পুরাতন বিল্ডিং যেগুলো রয়েছে, সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আর যেগুলো মোটামুটি অবস্থায় আছে সেগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচর্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল জানান, মাঝারি ভূমিকম্পও এদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এদেশের ভবনগুলো দুর্বল এবং ভূমিকম্প সহনশীল নয়। ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করতে প্রথম কাজই হবে ভূমিকম্পে ঝুঁকি কেন তার একটি মানচিত্র তৈরি করা। বিশেষ করে শহর এলাকার কোন জায়গার মাটি দুর্বল, কোন জায়গার শক্তিশালী তা বিবেচনায় নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু প্রাইভেট যে বাড়িঘর হয়ে গেছে সেগুলো তো পরিবর্বতন করা এত সহজ নয়। ব্যক্তির ওপর এটা নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে প্রথম কাজ হলো নগরবাসীকে সচেতন করা।