সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ আগুনে নিহত বেড়ে ৫২

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আরো ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে তিনজনের লাশ উদ্ধার হয়েছিল। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫২ জনে। নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে রূপগঞ্জের আকাশ-বাতাস। ঘটনাস্থলের আশপাশে বিলাপ করছে বহু মানুষ। গতকাল দুপুরে ফায়ার সার্ভিস যখন একটার পর একটা লাশ উদ্ধার করছিল তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেই দৃশ্য দেখে উপস্থিত কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি।

গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টার দিকে হাসেম ফুড কারখানাটির চতুর্থতলা থেকে ৪৯ টি লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার কর্মীরা জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া লাশগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চেনার কোন উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হবেনা।

এর আগে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অগিকান্ডের ঘটনায় দুই নারী স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নিহত হন। পরে রাত ১১ টার দিকে মোরসালিন (২৮) নামে আরো এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ তলা ভবনটির মধ্যে চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নির্বাপন সম্পন্ন হয়েছে। তবে পঞ্চম তলা ও ষষ্ঠ তলার আগুন নির্বাপনের কাজ চলছিল। আগুন নির্বাপনের পর মোট হতাহতের সংখ্যা বলা যাবে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। নিহতদের স্বজনরা কারখানার চারপাশে ভীড় জমিয়েছে। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার আশপাশে ভারি হয়ে উঠেছে।

এদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিক শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকরা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটায়। এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে অস্ত্রাগার থেকে তিনটি শর্টগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।
শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার কর্ণগোপ এলাকায় অবস্থিত সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক কর্মচারী কাজ করে। ছয়তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরের কার্টুন এবং পলিথিন তৈরীর কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সুত্রপাত ঘটে। এসময় আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছুটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়। তবে চারতলায় থাকা প্রায় ৭০-৮০ জন শ্রমিক কাজ করেন। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে চারতলার শ্রমিকরা ছুটাছুটি করতে থাকলে ওই তলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী কেচি গেইটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে বলে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ওই তলাতেই বসিয়ে রাখেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চার তলার শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। আগুনের খবর পেয়ে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। নিহতের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুন থেকে বাচঁতে রানী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন হক নিহত হয়। এছাড়া এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিকলে কলেজ ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নূসরাত জাহান, সহকারী কমিশনার (ভুমি) আতিকুল ইসলাম।

এদিকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ও আঞ্চলিক পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানাসহ ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের চলাচলরত গাড়িসহ মোট অর্ধশতাধিক গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এসময় শ্রমিকরা ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙ্গে তিনটি শর্টগান লুট করে নেয়। এসময় শ্রমিকদের হামলায় কাউসার, বিশ^জিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ প্রায় ৫ আনসার সদস্য আহত হয়।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কারখানার ভবনের প্রতিটি তলায় ক্যামিকেল ও ক্যামিকেল মিশ্রিত কাঁচামাল ছিলো। আর এসব ক্যামিকেলের কারণে আগুনের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে কারখানা চলাকালীন মালিকপক্ষ গেইট গুলো তালাবদ্ধ করে রেখেছে। আর আগুন লাগার সাথে সাথে শ্রমিকরা বের হতে পারে নি।

শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলতো। এ কারখানাটিকে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া কারখানাটিতে বেশিরভাগই শিশু শ্রমিক কাজ করতো। এছাড়া কারখানাটি অতিরিক্ত খাদ্য পন্যে অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহার করতো। এ কারণেই অতিরিক্ত ক্যামিকেলের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এতো দেরি হয়। এছাড়া কারখানাটির ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সী এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয় নি। এছাড়া নিহত শ্রমিকদের মাঝে বেশিরভাগই শিশু।

১২ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক বিশাখা রানী ক্ষোভের সূরে বলেন, বাবা মাসহ আমাদের ৫ বোনের সংসার। বেতন ভাতা ও ওভার টাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতনের ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই কারখানা মালিপক্ষ এই ভবনে আগুন লাগিয়ে আমার সপ্না রানীসহ অন্যান্য শ্রমিকদের হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।
নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চারতলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই।

নিখোঁজ শ্রমিক অমৃতা রানীর (১৭) বোন রোজিনা আক্তার জানান, তার বোন অমৃতা আক্তার চারতলায় কাজ করছিল। অমৃতা রানী বলছিল মালিকপক্ষ তাদের আটকিয়ে রেখে জোর করে ১২ ঘন্টা ডিউটি করাতেন। ঘটনার দিনও তারা কেচিগেট তালা দিয়ে রাখায় চারতলার কোন শ্রমিক বের হতে পারেনি। হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানাটির যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকান্ডে সূত্রপাত হয়।

কারখানা অন্যান্য শ্রমিক আরো অভিযোগ করে বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন ভাতা ঠিক মতো পরিশোধ করেন না। শ্রমিকরা বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ ও চাকুরীচ্যুত করা হুমকি ধামকি দিতো। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোন দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুত গতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। অগ্নিকান্ডে যারা নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে লাশ দাফনের জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের পরিবারদের নগদ ১০ হাজার টাকার করে দেওয়া হবে।

ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান বলেন, গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৫ টা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা হাসেম ফুডে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করেন। চারতলা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। শুক্রবার চতুর্থ তলা থেকে এ পর্যন্ত ৪৯ টি লাশ উদ্ধার করে হয়েছে। লাশ গুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তবে পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন এখনো থেমে থেমে জ¦লছে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ করলে বুঝা আরো হতাহতের সংখ্যা বাড়বে কিনা।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও হতাহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করে পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তসীর গাজী (বীর প্রতিক) বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে হতাহতের ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া এ ঘটনার ব্যপারে তদন্ত কমিটির উপর ছেড়ে দেয়া হলো। কারখানার অব্যবস্থাপনার কারণে যদি এ ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সে ব্যপারেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা ৪৮ জনের মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার রাত ১১টার দিকে মরদেহগুলোর ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস।

তিনি জানান, শুধু ফরেনসিক নয়, পাশাপাশি মরদেহের ডিএনএর প্রোফাইলয়ের জন্যও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নারী-পুরষসহ তারা মোট ৪৮টি মরদেহ পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন এই ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts