বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র যৌথ উদ্যোগে সোমবার (২৬ জুলাই) “সুন্দরবন বিষয়ে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সাম্প্রতিক সভার সুপারিশ” বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাপা ও সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি, সুলতানা কামাল এবং সঞ্চালনা ও মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন, বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন, বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপকআব্দুল আজিজ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ হারুন চৌধুরী, বাপা’র নির্বাহী সহ-সভাপতি এবং সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন এবং তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির অন্যতম সংগঠক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যানার্স এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপকগোলাম রহমান, বেনের সদস্য অধ্যপক ড. সাজেদ কামাল ও অধ্যাপক ড. খালেকুজ্জামান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম, বাপার কোষাধ্যক্ষ মহিদুল হক খান এবং পশুর রিভার ওয়াটারকিপার নুর আলম শেখ।
এছাড়াও ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সাম্প্রতিক সভায় সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির পক্ষে অংশগ্রহণকারী আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিবেশ কর্মী তন্নী নওশীন, ওয়ার্ড হেরিটেজ ওয়াচ এর চেয়ারম্যান স্টিফান ডম্পকে এবং জেনেভায় জাতিসঙ্ঘে আর্থ জাস্টিসের স্থায়ী প্রতিনিধি ইভস লেডর সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত থেকে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন।
সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, সুন্দরবন নানা কারণে আজ বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড়িয়েছে । সুন্দরবন ইস্যুতে সরকার বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সদস্যদের সাথে দেন-দরবার করেছে বলে মনে হয়। সেটির প্রমাণ গত ৪৪তম সভায় স্পষ্টভাবে বুঝা যায়। রাজনীতি দেশের ও জনগনের স্বার্থে হচ্ছে না কি মুষ্টিমেয় মুনাফালোভীদের স্বার্থে হচ্ছে তাও জাতিকে বুঝতে হবে। সুন্দরবন ইস্যুকে কেন্দ্র করে নিজ সংগঠনের এবং গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে একটি শক্ত মনিটরিং টিম গঠনের আহবান জানান তিনি। তিনি বলেন আজকে আমরা অত্যন্ত হতাশা ও ক্ষোভের সাথে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভার সুপারিশের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি। সুন্দরবন রক্ষায় নীতিগত কার্যপরিকল্পনা গ্রহণের আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
শরীফ জামিল মূল বক্তব্যে বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভায় বিশ্বের ১৯৯টি বিশ্ব ঐতিহ্য বিষয়ে বিশ্লেষণ ও আলোচনা করা হয় যার মধ্যে সুন্দরবন বিষয়টিও ছিল। কমিটি তার দুর্বল সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সুন্দরবনের ঐতিহ্য সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যার্থ হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং এর স্বপক্ষে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের খসড়া সুপারিশ এবং কমিটি সিদ্ধান্তের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কমিটির সদস্যরা রাজনৈতিক বিবেচনাকে বিজ্ঞান এবং আদর্শের চেয়ে বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন বলে তিনি তার বক্তব্যে জানান।
স্টিফেন ডমপকে বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির অধিবেশন চলাকালীন আমরা কার্যত শক্তিহীন ছিলাম । সুতরাং আমাদের জনসাধারণের দ্বারা চাপ সৃষ্টি করা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন অবশ্য করণীয় । এই বিষয়টি আসন্ন কপ (COP)- এ উত্থাপন করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে তিনি উল্লেখ করেন, ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভায় রাজনৈতিক প্রভাব কয়েক বছর যাবত প্রকটভাবে দেখা গেলেও এবছর তা কেবল সুন্দরবন নয়, অন্যান্য ঐতিহ্যের বেলায়ও প্রকটভাবে লক্ষ্য করা গেছে।
ইভস লেডর বলেন, জনগনের মতামত এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিরুদ্ধে গিয়ে ইউনেস্কোর মত বৈশ্বিক মঞ্চে সরকারের পরিবেশ বিরোধী কৌশল অবলম্বন করার কারণে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্থ হবে । বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে রাজনীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, আমাদের সবার জন্য ভয়ানক পরিণতি বয়ে আনবে । বিজ্ঞানকে ভিত্তি করেই যেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সেখানে এ ধরণের বিজ্ঞান অবহেলিত কর্মকাণ্ডের প্রবণতা আমাদের সকলের চিন্তার কারণ।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এটি একটি বিদ্যুকেন্দ্রও না, উন্নয়ন না, জিও পলিটিক্যাল এজন্ডা। কেন সরকার এতো বিরোধিতা করার পরেও এধরণের জনবিধ্বংসী কাজে এগিয়ে যাচ্ছে। যে সমস্ত প্রকল্প অলস পড়ে আছে সে সমস্ত প্রকল্পে সরকার প্রচুর পরিমাণ অর্থ খরচ করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। মূলত অন্য ১০টি প্রকল্পের অর্থ জোগাড় করতে পারে নি এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় অর্থ আসেনি বলেই সরকার ১০টি প্রকল্প বাতিল করেছে; কিন্তু সুন্দরবনের প্রকল্প কেন বাতিল করা হলো না । সরকার যে প্রকল্পের জন্য নিজের দেশের জনগনের সমর্থন নাই সেই প্রকল্পের জন্য বিদেশিদের সাথে দেন দরবার চালিয়ে যাচ্ছে যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। লবিগুলো করার টাকা সরকার কোথায় পায় তা জাতি জানতে চায়। মূলত সরকারে এনভায়নমেন্টাল এসেমেন্ট একটি গ্রীন ওয়াশিং ডকুমেন্টস। আমরা পরিবেশের ক্ষতি না করে নিজস্ব অর্থায়নে উন্নয়ন করতে চাই। চীন, ইন্ডিয়া এবং রাশিয়ার বাংলাদেশে এ ধরনের প্রকল্পে ইনভেস্টমেন্ট আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ হারুন চৌধুরী বলেন, সরকারকে ব্যবসার দিকে না গুরুত্ব দিয়ে সুন্দরবন রক্ষার দিকে গুরুত্ব দেওয়ার দাবী জানান তিনি। কোন উন্নয়ন দ্বারা এ ধরনের সুন্দরবন তৈরী হবে না। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে এ ধরনের অমুল্য সম্পদ রক্ষা বা তৈরী করা যাবে না।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটি রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। সরকার যে তকমা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কর্মযজ্ঞ করা হচ্ছে তাও ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। এখনই সব কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করার দাবী জানান তিনি। আগামী দিনে গণজোয়ারের মাধ্যমে সুন্দরবনসহ দেশের সকল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প বন্ধ করার দাবী জানান তিনি।
অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ বিষয় চালু চালু হয়েছিল সুন্দরবনকে কেন্দ্র করে। কিভাবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যায় এ উদ্দেশ্যে আমাদের সংঘবদ্ধ হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
ড. সাজেদ কামাল বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ বৈশ্বিক নেতৃত্ব প্রদান করছে। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিপন্থী এবং আত্মঘাতী । বাংলাদেশের সক্ষমতা রয়েছে পরিচ্ছন্ন এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা । টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এবং বৈশ্বিক নেতৃত্বদানকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে বিজ্ঞানভিত্তিক পরিকল্পনা আমলে নেওয়া প্রয়োজন।
ড. খালেকুজ্জামান বলেন, আমাদের দেশের সরকার জনবিমুখ সরকারে পরিনত হয়েছে। তিনি বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে সুন্দরবনের রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপ বিদুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
তন্নী নওশীন বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির গত ৪৪তম সভা আমাদের জন্য শুধুই ক্ষোভ ও কষ্টের বিষয় ছিল। কয়লা প্রকল্প যেন সুন্দরবনে করা না হয় সে জন্য আমাদের বক্তব্য প্রদান করেছি। সভায় কমিটির কিছু কিছু সদস্য বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু নিম্ন আয়ের দেশ সেখানে উন্নত হওয়া দরকার তাই বাংলাদেশ সরকারকে এ বিষয়ে বেশী চাপ দেওয়ার প্রয়োজন নাই বলে মন্তব্য করেন।
নুর আলম শেখ বলেন, ভারত থেকে যে সমস্ত কার্গোজাহাজ আসছে সে সমস্ত কার্গোর চালকরা বলেছেন এই কয়লাগুলো একেবারে নিম্নমানের। তিনি বলেন ইউনেস্কোর নানা সুপারিশ অবজ্ঞা করে পশুর নদীর ২১ কিমি চায়নার একটি কোম্পানী ড্রেজিং করছে এবং এর বালি বা মাটি নদীর পাশে গ্রামে ফেলছে যার ফলে এলাকার কৃষকরা তাদের কৃষিজমি ও বসতভিটা হারাচ্ছে।
সভায় দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জন্য চলমান কৌশলগত পরিবেশ সমীক্ষা সরকারী প্রভাবে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে না করে, নিরপেক্ষ, বিজ্ঞানভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট দাবী জানানো হয়। সাথেসাথে রামপাল, তালতলি ও কলাপাড়ার সকল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ করা এবং সুন্দরবনের ভেতরদিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য বহনকারী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধের দাবীও সভায় তুলে ধরা হয়।
সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান: