জয়ের জন্মের কঠিন সময়ের গাঁথা শোনালেন মা শেখ হাসিনা

জয়ের জন্মদিনে দেশবাসীর দোয়া চাইলেন

বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ ডিজিটিল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সজীব ওয়াজেদ জয়ের অবদানের কথা তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ। এই ডিজিটাল বাংলাদেশ জয়েরই অবদান। আমি ও আমার বন্ধু কম্পিউটার শিখলাম জয়ের কাছ থেকেই। আমরা যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়লাম সেটা জয়েরই চিন্তা। আমি দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে গর্ভে ধারণ, আর তার জন্মের পরের কঠিন সময়টার গল্প শোনালেন মা শেখ হাসিনা।

মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জনপ্রশাসন পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, “আজকে যেই ডিজিটাল বাংলাদেশে আমি আপনাদের সাথে কথা বলছি, এটা কিন্তু জয়েরই ধারণা, জয়েরই চিন্তা।’

মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই ঢাকায় পরমাণু বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা দম্পতির ঘরে জন্ম নেন সজীব ওয়াজেদ জয়। মঙ্গলবার তার জীবনের ৫০ বছর পূর্ণ হল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে আসা জয় ২০০৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ‘গ্লোবাল লিডার অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নির্বাচিত হন।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে জয়ের বড় ধরনের ভূমিকার কথা বলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। তাদের ভাষ্য, নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’র ধারণা জয়ের উদ্যোগেই যুক্ত হয়েছিল। আর তা তরুণ প্রজন্মের মন কেড়ে নেয়।

ছেলের নাম কীভাবে ঠিক হয়েছিল, সেই স্মৃতি স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, প্রথম সন্তান তার গর্ভে।

“২৩ মার্চ আপনারা জানেন পাকিস্তান দিবস হিসেবে…, ইয়াহিয়া খান তখন ঢাকায়। সারা বাংলাদেশে কিন্তু পাকিস্তানি পতাকা কেউ ওড়ায়নি। সেইদিন সমস্ত বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল। ৩২ নম্বর বাড়িতেও সেদিন আমার বাবা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন। যদিও পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান তখন ঢাকায় ছিল, কিন্তু তাকে সবাই অস্বীকার করেছিল।

“বঙ্গবন্ধুর হাত, পায়ের নখ কেটে দেওয়া আমার নিয়মিত কাজ ছিল। তিনি যখন বিশ্রম নিতে বসেছেন দুপুরে, আমি তখন একটা মগে পানি নিয়ে তার হাতের নখ কেটে দিচ্ছি। তখন তিনি বললেন- ‘হ্যাঁ ভালোভাবে কেটে দে। জানি না আর এই সুযোগ পাবি কিনা। তবে তোর ছেলে হবে। এবং সেই ছেলে স্বাধীন বাংলাদেশে জন্ম নেবে। তার নাম জয় রাখবি’।”

এরপর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় বর্বর গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে।

কিছুদিন পর বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, ছেলে শেখ জামাল ও শেখ রাসেল, মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে গ্রেপ্তার করে ১৮ নম্বর রোডের একটি একতলা বাসায় আটকে রাখে পাকিস্তানিরা।

সেসব দিনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “যখন আমার সন্তান প্রসবের সময় হয়, আমাকে পাকিস্তানি মিলিটারিরা হাসপাতালে যেতে দিয়েছিল, কিন্তু আমার মাকে যেতে দেয়নি।”

ওই সময় হাসপাতাল থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমি যখন বন্দি, সেই বন্দি অবস্থায় জয়ের জন্ম। এবং তার নাম জয়ই আমরা রেখেছিলাম।”

তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে বন্দিশালায় ফিরে আসার পর একদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময় পাকিস্তানি এক সেনা কর্মকর্তা তার ছেলের নাম জানতে চান। শেখ হাসিনা ছেলের নাম বলতেই সেই সেনা কর্মকর্তা নামের অর্থ জানতে চান।

শেখ হাসিনা তাকে বলেছিলেন, জয় মানে ‘ভিক্টরি’। তখন সেই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা খুব ক্ষেপে যায় এবং শিশু জয়কেও গালি দেয় বলে জানান তার মা।

তিনি বলেন, “কাজেই এই রকম একটা পরিবেশেই কিন্তু জয়ের জন্ম। সেখানে আমরা ফ্লোরেই থাকতাম, কোনো প্রাইভেসি ছিল না। একতলা একটা বাড়ি। ওই অবস্থার মধ্যে খাওয়া দাওয়ারও কোনো ঠিক ছিল না।

“ওকে নিয়ে আমি যখন একটা বাড়ি থেকে আরেকটা বাড়িতে আশ্রয় নিই, তখন জানি না কীভাবে বেঁচে ছিলাম। খাওয়া দাওয়া কোনো কিছুরই ঠিক ছিল না। কেবল আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতাম, আমার বাচ্চাটা যেন একটা সুস্থ বাচ্চা হয়। আমার মা সব সময় সেই দোয়াই করতেন।”

শেখ হাসিনা বলেন, “আজকে সেই জয়ের জন্মদিন। পঞ্চাশ বছর তার বয়স হল। এই করোনার কারণে আমরা সবাই এক হতে পারলাম না। এটা আরেকটা দুঃখ। আপনারা এই দিনটি স্মরণ করছেন, সেজন্য আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।”

সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন উপলক্ষে মঙ্গলবার গণভবনে ‘সজীব ওয়াজেদ জয়, তারুণ্যদীপ্ত গর্বিত পথচলা’ এবং Sajeeb Wajed Joy: A Spirited Graceful Journey’ শিরোনামে দুটি মইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত স্মারক ডাকটিকেট, উদ্বোধনী খাম ও বিশেষ সিলমোহর অবমুক্ত করেন তিনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার সময় মা ও বাবার সঙ্গে জার্মানিতে ছিলেন জয়। এরপর মায়ের সঙ্গে ভারতে চলে যান। সেখানেই কাটে শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো।

নৈনিতালের সেন্ট জোসেফ কলেজে পড়ালেখার পর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট আর্লিংটন থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি নেন জয়। পরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে জনপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর করেন।

জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটানোর অভিজ্ঞতা এবং তারপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাপ্রবাহ শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “ওই গৃহবন্দি থাকা অবস্থায়ই জয়কে আমার আব্বার বন্ধু আজিজ সাত্তার কাকা, তিনি নৈনিতালে নিয়ে জয় ও পুতুলকে ভর্তি করে দেন। কাজেই সেখানে পড়াশোনা করত বলেই স্কুল থেকেই কম্পিউটার শিক্ষা নেয়। যখন ছুটিতে আসত, কম্পিউটার নিয়ে আসত। জয়ের কাছ থেকে আমি কম্পিউটার শিখেছি।”

১৯৯১ সালে দলের জন্য অনেক দাম দিয়ে কম্পিউটার কেনার কথা তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, দেশে কীভাবে কম্পিউটার শিক্ষার প্রচলন করা যায়, সেই চিন্তা তখন থেকেই তার ছিল।

পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে কম্পিউটারের উপর থেকে কর তুলে নিয়ে এ প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করে তোলার কথা বলেন তার মা শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, জয় তখন পরামর্শ দিয়েছিলেন, মানুষকে কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিলে মানুষ তা শিখবে। আর সেভাবেই ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘যাত্রার শুরু’।

কম্পিউটার ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে সরকারের এসে তিনি দেখিছিলেন, কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করে না। তখন তিনি নির্দেশ দেন প্রতিটি ফাইল কম্পিউটারে টাইপ করে আনতে হবে।

“আলহামদুলিল্লাহ, আজকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি এবং ধাপে ধাপে এই পর্যন্ত যতগুলো কাজ আমরা করেছি, সবগুলোই কিন্তু তার (জয়) পরামর্শ মত।”

সরকার প্রধান বলেন, “আমি এইটুকু বলব, আজকে যে আমরা বাংলাদেশকে ডিজিটাল করতে পেরেছি, প্রযুক্তি শিক্ষাটাকে পপুলার করতে পেরেছি এবং আমাদের যুব সমাজ, তরুণ সমাজ- এই তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করা, তরুণ সমাজ যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং সেইভাবে জয়, আমার বোনের ছেলে রাদওয়ান সিদ্দিক থেকে শুরু করে ওরা সবাই কিন্ত ওভাবেই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করেছে। যার শুভ ফলটা আজকে বাংলাদেশ ভোগ করছে।

“নইলে করোনাকালীন সময়ে আমি যদি চিন্তা করি, আমাদের যদি এই সুযোগটা না থাকত, আমাদের এই ডিজিটাল ডোরটা যদি ওপেন না থাকত, উন্মুক্ত না থাকত, আমরা কী অবস্থায় যেতাম। আমাদের সরকার চালানো মুশকিল হয়ে যেত। মানুষের জীবনযাত্রায় একটা বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হত। আজকে আধুনিক প্রযুক্তির শিক্ষা আমরা নিয়েছি বলেই কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে।”

Print Friendly

Related Posts