বিডিমেট্রোনিউজ ডেস্ক ॥ মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দ্রুত বদলে গেল সব, বিনা প্রতিরোধে তালেবান বাহিনী রাজধানী কাবুলে প্রবেশের পর পালিয়ে গেলেন প্রেসিডেন্ট, দূতাবাস খালি করে কূটনীতিকদের সরিয়ে নিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। দুই দশক পর আবারও আফগানিস্তানবাসী ফিরল গোঁড়া ইসলামী দলটির শাসনে।
রোববার (১৫ আগস্ট) কাবুলে ঢুকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ তালেবান নেওয়ার পর দলটির একজন নেতার বরাত দিয়ে কয়েকটি সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকেই শিগগিরই তারা এই দেশকে আবার ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফিগানিস্তান’ ঘোষণা করবে।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার জঙ্গি হামলার পর মার্কিন অভিযানে আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার আগে পাঁচ বছর এই নামেই দেশকে চালিয়েছিল তারা।
তালেবানের শাসনে শরিয়াহ আইন ফেরার ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই দেখা গেছে কাবুলের বিভিন্ন দেয়াল থেকে নারীদের ছবি মুছে ফেলার মধ্যদিয়ে। সাংবাদিকসহ কর্মজীবী নারীরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন বলে সিএনএন’র এক সাংবাদিক জানিয়েছেন।
বর্তমানে কানাডায় অবস্থানরত আফগান পার্লামেন্টের সাবেক নারী সদস্য সাবরিনা সাকেব বিবিসিকে বলেছেন, হয়ত আমি অনেক দূরে আছি, তবে নিজেকে এখন গৃহহীন মনে হচ্ছে।
আফগানিস্তানের নারী, সংখ্যালঘু ও মানবাধিকার কর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই।
কাবুলের পথ ঘুরে সিএনএনের সাংবাদিক ক্লারিসা ওয়ার্ড বলেছেন, সর্বত্র আতঙ্ক, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির শঙ্কা করছে শহরবাসী। ধর্মীয় গোঁড়ামি নিয়ে যারা ছিল উচ্চকণ্ঠ, সেই সব নারীরা চরম উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন বলে জানান ক্লারিসা। মাজার-ই শরিফ থেকে নারী গভর্নর সেলিমা মাজারি আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন, নারীদের জন্য আর কোনো জায়গাই থাকল না। তাদের এখন ঘরে বন্দি থাকতে হবে।
মাজার ই শরিফ দখলের পরদিনই রোববার কাবুলে ঢুকে পড়ে তালেবান। দলটির নেতারা নাগরিকদের ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে কোনো ধরনের প্রতিশোধ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পাকিস্তান সীমান্তে ঢল নেমেছে আফগানদের। সংঘাত-সহিংসতার ভয়ে দলে দলে আফগানরা প্রতিবেশী দেশে চলে যেতে চাইছে।
আফগানিস্তানের এক এমপি বিবিসিকে বলেছেন, আমি বাসা থেকে দেখতে পাচ্ছি, মানুষজন পালানোর জন্য রাস্তা দিয়ে ছুটছে। জানি না তারা কোথায় যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঘর থেকে পালিয়ে তারা কোন রাস্তা দিয়ে কোথায় যাবে জানে না। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তারা চলেছে। খুবই হৃদয়বিদারক দৃশ্য।
সোভিয়েত বাহিনী চলে যাওয়ার পর গৃহযুদ্ধের মধ্যে মোল্লা ওমর নেতৃত্বাধীন তালেবান ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। তবে আল কায়দার শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেনকে আশ্রয় দেওয়ার পরিণতিতে তাদের ক্ষমতা টলে যায়।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বহুজাতিক বাহিনী আফগানিস্তানে অভিযান শুরুর পর তালেবানকে পিছু হটতে হয়। টানা অভিযানে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। কিছু আত্মঘাতী ও আচমকা হামলা দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বটুকুই কেবল তারা জানান দিতে পারছিল।
তবে এর মধ্যে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসা হামিদ কারজাই তার ১৩ বছরের শাসনে এবং এরপর আশরাফ গানি ছয় বছরের শাসনেও দেশে স্থিতিশীলতা আনতে পারেননি।
অভিযানের বিশাল ব্যয় বহনের চাপে থাকা যুক্তরাষ্ট্র ২০১৮ সালে তালেবানের সঙ্গে চুক্তি করে আফগানিস্তান ছাড়ার পথ তৈরি করে। তখনই আফগান নীতি-নির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছিল। কয়েকমাস আগে যুক্তরাষ্ট্রের অবশিষ্ট সৈন্যরা আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে না যেতেই তালেবান একের পর এক শহরে নিয়ন্ত্রণ নিতে থাকে। চার দিক থেকে যখন শনিবার কাবুল ঘিরে ফেলে, তখনই সরকারের পতনের শঙ্কা দেখা দেয়। এমন এক পরিস্থিতিতে আফগান প্রেসিডেন্ট গানি দেশ ছাড়ার পর কাবুলে ঢুকে পড়ে তালেবান।
ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল বিসমিল্লাহ মোহাম্মদী প্রেসিডেন্ট গানির আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে সরাসরিই বলেন, আমাদের হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দেশটা বিক্রি করে দিয়ে চলে গেল ওই ধনী লোক আর তার গ্যাং।
সমালোচনার মুখে আত্মপক্ষ সমর্থন করে আশরাফ গানি অবশ্য বলেছেন, রক্তপাত এড়াতে তার হাতে আর কোনো ‘বিকল্প ছিল না’। ফেইসবুক পোস্টে তিনি বলেন, সংঘাত এড়ানোর জন্যই তিনি কাবুল ছেড়েছেন, কারণ লাখো মানুষ সেখানে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
কাবুল থেকে জ্যেষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ে কাবুল থেকে তাজিকস্তানের উদ্দেশে উড়াল দেওয়ার পর দেশের পরিস্থিতি নিয়ে তার বক্তব্য এলেও তিনি কোথায় রয়েছেন, তা এখনও অজানা। তিনি উজবেকিস্তানে গেছেন বলেও খবর শোনা যাচ্ছে।
এদিকে কাবুল দখল করতে তালেবানকে কোনো যুদ্ধই করতে হয়নি। সরকারি সৈন্যরা সব ভয়েই পালিয়েছিল। শনিবার থেকে কাবুল ঘিরে রাখা তালেবানের মুখপাত্র সুহেল শাহিন বলেন, নিরাপত্তা রক্ষী ও পুলিশ পালিয়ে যাওয়ায় ডাকাতি-রাহাজানি ঠেকাতে, সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে তারা রাজধানীতে ঢুকেছেন।
তালেবান ঢুকে পড়ার আগে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল সাত্তার মিরজাকওয়াল বলেছিলেন, তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান। এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ‘শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের’ প্রক্রিয়া শুরু করেছেন তারা। তালেবান সূত্রের বরাত দিয়ে আফগানিস্তানের টোলো নিউজের খবরে বলা হয়েছিল, আশরাফ গানি পদত্যাগ করে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে।
এরপর প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে অস্ত্র হাতে তালেবান যোদ্ধাদের অবস্থান এবং ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য আসছে সোশাল মিডিয়ায়। আর অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো পতাকা নামিয়ে তাদের কূটনীতিদকদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নিজ নিজ দেশে। এজন্য কাবুলের হামিদ কারজাই বিমানবন্দরে রোববার ভিড়ের সঙ্গে ছিল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও, কারণ সেখানেই গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের দূতাবাস গুটিয়ে বিমানবন্দরে থেকেই কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। সিএনএন জানিয়েছে, নাগরিকদের নিরাপদে ফেরত পাঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আপাতত কাবুলেই থাকছেন।
গত কিছুদিন ধরে তালেবানের অগ্রযাত্রার ধরন দেখেও ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণায় অটল থেকে আফগানিস্তানকে এই পরিণতির দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য এখন ঘরে বাইরে সমালোচিত হচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
অবশ্য তার প্রশাসন কাবুলের পতনকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ১৯৭৫ সালের সায়গন পতনের সঙ্গে তুলনা করতে নারাজ।
রাজধানী কাবুলে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে তালেবান।
দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী চলে যাওয়ার পর ও সোমবার পশ্চিমা দেশগুলো তাড়াহুড়া করে তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টার মধ্যেই তালেবান এ ঘোষণা দেয় বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
গোঁড়া ইসলামি দলটির যোদ্ধারা কাবুলে প্রবেশের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি; রক্তপাত এড়াতেই দেশ ছেড়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে দেশ ত্যাগে মরিয়া শত শত আফগান কাবুল বিমানবন্দরে জড়ো হয়েছেন।
এ পরিস্থিতিতেই তালেবানের রাজনৈতিক দপ্তরের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাঈম আল জাজিরা টেলিভিশনকে বলেন, আজ আফগান জনগণ ও মুজাহিদিনদের জন্য একটা মহান দিন। তারা ২০ বছর ধরে তাদের ত্যাগের ও চেষ্টার ফল দেখতে পাচ্ছে। আল্লাহকে ধন্যবাদ, দেশে যুদ্ধ শেষ হয়েছে।