বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), নিজেরা করি এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)’র যৌথ উদ্যোগে রোববার (২৯আগষ্ট) সামাজিক বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস, খাসিয়া আদিবাসীদের উপর হামলা ও উচ্ছেদ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
বাপা সভাপতি সুলতানা কামাল এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন বাপা আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও পরিবেশ বিষয়ক কমিটি’র আহবায়ক ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা ও মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা এবং আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম।
এছাড়া উক্ত এলাকা পরিদর্শন করে অভিজ্ঞতা বর্ননা করেন, ফাদার যোসেফ গোমেজ, ফ্লোরা বাবলী তালাং এবং আব্দুল করিম কিম।
সভাপতির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের বিষয় নতুন নয় বরং ধারাবাহিক ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ। এখন এটি আর ষড়যন্ত্রের পর্যায়ে নেই বরং তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় আছে। আদিবাসীদের নিশ্চিহ্ন হওয়া এখন সময়ের ব্যপার।
দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মাঝে এ সমস্ত অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ডের খবর ছড়িয়ে দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে তিনি মনে করেন।
সুলতানা কামাল বলেন, দেশে নাগরিক রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার ভয়ানকভাবে লংঘিত হচ্ছে। দূস্কৃতিকারীরা দেশে বর্তমানে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে এটা দিয়ে তারা পার পেয়ে যাবে বলে মনে করছে। বন বিভাগের কাজ হচ্ছে দেশের বন সংরক্ষণ করা কিন্তু বনবিভাগের কাজের মধ্যে বন সংক্ষণের কোন লক্ষনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, দেশের কয়জন আদিবাসী হঠাৎ করে ধনী হয়েছে এবং কয়জন বনবিভাগের কর্মকর্তা কোটিপতি হয়েছেন তার হিসাব নিতে হবে। বনবিভাগের কর্মকর্তারা বনকে টার্গেটের মধ্যে নিয়ে তাদের আখের গোছানোর কাজে লিপ্ত থাকে। আদিবাসীরা প্রকৃতির সঙ্গে বসবাস করে, তারা প্রকৃতি ও বনভূমিকে লালন ও সংরক্ষণ করে বসবাস করে। বন তাদের ধর্মীয় চিন্তা এবং সংস্কৃতির মধ্যেই রয়েছে।
তিনি গনমাধ্যমকে বনবিভাগের কর্মকান্ড দেসবাসীর কাছে তুলে ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটি সভ্য দেশে একটি জনগোষ্টি কখনও আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে পারে না, আর যদি তা’হয় তবে মনে করতে হবে সেখানে অবশ্যই মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর জনগনের স্থায়ী নিরাপত্তার দাবী জানান। প্রকৃতিকে নির্যাতন করে কোন জাতি টিকে থাকতে পারে না।
সঞ্জীব দ্রং অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, বন হচ্ছে খাসিয়াদের ঐহিত্যগত ভূমি। অথচ তাদের ভূমির কোন কাগজপত্র নাই। তিনি বলেন বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করবে। আদিবাসীদের ভূমি কমিশন না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে কেউ উচ্ছেদ করতে পারবেনা মর্মে একটি লিখিত ডকুমেন্ট প্রদানের দাবী জানান তিনি।
শরীফ জামিল মূল বক্তব্যে বলেন, দেশের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে চরম অধিকার বঞ্চিত ৩০ লক্ষের বেশী আদিবাসী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যের অন্যতম ধারক ও বাহক। সারাবিশ্বে আদিবাসীদের প্রকৃতির সন্তান হিসাবে বিবেচনা করে জাতিসংঘের উদ্যোগে তাদের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিশেষ বিশেষ কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের আদিবাসীরাও তাদের জীবন, জীবিকা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও আচার আচরণের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ করে আসছে।
সিলেট অঞ্চলে যুগযুগ ধরে বসবাসরত খাসি ও গারো আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রথাগতভাবে পান চাষের মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যে সমস্ত এলাকা আদিবাসীদের পান চাষের আওতায় রয়েছে, সেই সমস্ত এলাকায় এখনো প্রাকৃতিক বন বিদ্যমান। অন্যথায় লাউয়াছড়া, রাতারগুল এবং লাঠিটিলার মত সংরক্ষিত বনাঞ্চলও চরম দুর্নীতি ও অব্যাবস্থাপনার কবলে হারাতে বসেছে। তথ্য গোপন করে অথবা ভুল তথ্যের উপর ভিত্তিকরে ইজারা প্রাপ্ত কিছু কিছু চা বাগান দীর্ঘদিন যাবত বেশ কয়েকটি আদিবাসী গ্রাম থেকে খাসিয়াদের উচ্ছেদের উদ্যেশ্যে প্রাকৃতিক বনে গাছ কাটা, হামলা, মিথ্যা মামলা, রাতের আঁধারে পান গাছ কেটে ফেলাসহ তাদের আসা যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। অতিসম্প্রতি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলায় ডলুছড়া পুঞ্জিতে সামাজিক বনায়নের নামে খাসিয়া উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বনবিভাগের সাথে চলমান একই বিরোধের জেরে কর্মধা ইউনিয়নের বেলূয়াপুঞ্জিতে পাঁচটি খাসি–গারো পরিবারের দুই হাজার আটশতাধিক পানগাছ কাটা হয়। বেলূয়াপুঞ্জির ঘটনার সুরাহা না হতেই, আবারও শুক্রবার (২৭ আগস্ট) ডলুছড়া পুঞ্জিতে ভোর পাঁচটায় পিটুস খাসিয়া, লরেন্স খাসিয়া ও ফেরকত খাসিয়ার তিনটি জুমের প্রায় পাঁচশতাধিক পান গাছ কেটে ফেলেছে স্থানীয় ভূমিখোর ও দখলবাজ দুষ্কৃতকারীরা। একই দিনে পুঞ্জির বাইরে একাধিক জায়গায় খাসিদের উপর হামলা চালায় এবং ৫ জন আহত হয়।
খুশী কবির বলেন, বনবিভাগের কাজ হচ্ছে বনকে রক্ষণ করা, বনের গাছকাটা না। বনবিভাগের কাজ কি সেটি জানার সময় এসছে এখন। বনবিভাগ তাদের লোকজন দিয়ে আদিবাসীদের উপর হামলা করছে। আদিবাসীদের অধিকারের কথা আইনে বলা আছে কিন্তু এখানে স্পষ্ট আইন লংঘন করা হচ্ছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশের উপর কাজ করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতা বর্ননায় বলেন, দেশে বর্তমানে যে বনবিভাগ রয়েছে এ বনবিভাগের কোন প্রয়োজন নাই। বৃটিশদের করে যাওয়া ১৯২৭ সালের আইন দিয়ে বনবিভাগ চলছে, এই বনবিভাগ এ দেশের না এটা বৃটিশদের। বনবিভাগের বনের জমির উপর বেশ মায়া কিন্তু বনের উপর না।
শামসুল হুদা বলেন, বনবিভাগের এধরনের কার্যক্রম আমরা নতুন দেখছি না, বরং এটি অনেক আগের। তবে এটি এখন আরো ব্যপক আকারে হচ্ছে। তাদের এধরেনের কর্মকান্ড আর হতে দেওয়া হবে না। বনবিভাগকে এখন বনদস্যু বিভাগ বলা উচিত। আমাদের অতি দ্রুত দেশের ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে একটি খসড়া তৈরী করা উচিত। আমাদেরকে সমস্যার গোড়ায় গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে এ ধরনের নিলর্জ্বপনা আর চলতে দেওয়া যায়না।
তিনি বনবিভাগে যারা ২০-৩০ বছর ধরে চাকরি করছেন তাদের প্রত্যেকের সম্পদের হিসাব নেওয়ার জন্য দূদকের প্রতি তিনি আহবান জানান।
ফাদার যোসেফ গোমেজ বলেন্, জেলা প্রশাসক চান না পাহাড়ে বসবাসরত স্থানে এ ধরনের সামাজিক বনায়ন হোক। এ বিষয়ে তারা তাদের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ করেন। রাজনৈতিক ব্যনারে এখানে সামাজিক বনায়নের কর্মকান্ড করার প্রচেষ্টা চলছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
অনুমোদনহীন উপকার ভোগীর তালিকা কে করলো কিভাবে হলো তা তদন্তের দাবী জানান তিনি। এ অঞ্চলের বিট কর্মকর্তা এ অনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত বলে তিনি দাবী করেন। তাদের কি বিচারের আয়োতায় আনার দাবী জানান তিনি।
সম্পূর্ন অনুষ্ঠান: