প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ বলে দাবি করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন।
বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০ টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী মিলনায়তনে (২য় তলা) সংগঠনের ৩য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘প্লাস্টিক দূষণে বাংলাদেশ: উত্তরণের উপায়” শীর্ষক আলোচনা সভা, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন ও গ্রিনম্যান অ্যাওয়ার্ড প্রদান অনুষ্ঠানে এ দাবি করে সংগঠনটি।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে সবুজ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, “প্লাস্টিক দূষণ বলতে প্লাস্টিক পদার্থ ব্যবহারের পর অপচনশীল দ্রব্য হিসেবে যা বন্যপ্রাণী, পৃথিবীর আবাসস্থল এবং মানব সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মূলত মাইক্রো, মেসো এবং মাইক্রোবর্জ্য তিন রকমের প্লাস্টিক পণ্যের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা যেতে পারে।
গত ২০২০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২১ ইং ১ আগস্ট পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে ২০ জেলার ১০০ জন করে ব্যক্তির উপর প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার ও দূষণ সম্পর্কে জরিপ চালানো হয়, যা বাস্তবায়ন করে সবুজ আন্দোলন তথ্য ও গবেষণা পরিষদ। বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, মাগুরা, টাঙ্গাইল, পঞ্চগড়, রংপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, মেহেরপুর, যশোর, ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, নওগাঁ, বগুড়া, নীলফামারী, নরসিংদী, ময়মনসিংহ, ভোলা জেলায় সাংগঠনিক কাজ এবং গবেষণা চালানো হয়।
তাতে দেখা গেছে বাংলাদেশের শতকরা ৯৮ ভাগ জনগণ প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করেন তবে ২ ভাগ জনগণ এখনো কাঁচ ও মাটির পন্য ব্যবহার করেন। অধিকাংশ মানুষ প্লাস্টিক পণ্য সহজলভ্য হওয়ায় ব্যবহারে আগ্রহী আবার প্রবীণ ও কিছু সচেতন ব্যক্তি পাটজাত পণ্য ও কাপড়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করেন। তবে তরুণ প্রজন্মই প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বেশি করে থাকেন। গ্রামাঞ্চলে প্লাস্টিকের ব্যাগ একবার ক্রয় করলে পুনরায় পরিষ্কার করে ব্যবহার করার প্রবণতা বেশি। সে ক্ষেত্রে শহর অঞ্চলে একবার ব্যাবহারের চিত্র বেশি। প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ।”
তিনি আরো বলেন, “আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে ১৯৫০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৭৫০ কোটি টন প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার করা হয়েছে। যার মধ্যে ব্যবহৃত ৮০ ভাগ পণ্যের পচন ধরেনি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ প্রায় ১৩০০ কোটি টন প্লাস্টিক ব্যবহার করা হতে পারে। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায় প্রতি মিনিটে সাগরে ৩৫ হাজার প্লাস্টিক পণ্য পানিতে গিয়ে পড়ে। যা বছরে গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ মিলিয়ন। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে কার্বন নিঃসরণ ও বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি বছর সারা পৃথিবী জুড়ে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনে ১৮ মিলিয়ন ব্যারেল তেল দরকার পড়ে। প্রতি কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে ২/৩ কেজি কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়। যার ফলে জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। প্লাস্টিক মোড়কে জোড়া খাবার যখন ফ্রিজে রাখা হয় পরবর্তীতে সেটি বাইরে বের করলে স্টাইরিন নামক গ্যাস উৎপাদিত হয় যা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে বা লোমকূপ দিয়ে মানব দেহে প্রবেশ করে। যার ফলে মাথা ব্যাথা, দুর্বলতা, জটিল ও কঠিন রোগ ব্যাধির জন্য এমনকি স্নায়ুতন্ত্র বিকলের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। প্লাস্টিকের পানির বোতল ও ট্যাপ ব্যবহারের প্রবণতা বেশি। যার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস, এলার্জি, হাঁপানি, চর্ম রোগ, থাইরয়েডের অতিরুক্ত হরমোন ধারণ এবং ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগ দেখা দিয়েছে।”
বাপ্পি সরদার বলেন, “সাগরে পতিত প্লাস্টিক পণ্যে সূর্য রশ্মির বিকিরণ ঘটে, যার ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়ে মাছের শরীরে প্রবেশ করে। অতিরিক্ত প্লাস্টিক পণ্য সাগরে পতিত হওয়ায় প্রায় ৮৫০ প্রজাতির জলজ প্রাণী রোগে আক্রান্ত হয়। প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ লাখ পাখি প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়। প্রতিবছর মাথাপিছু একজন ব্যক্তি ১৮ কেজি পলিথিন ব্যবহার করে। নিম্নমানের পলিথিন উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য ও রং ব্যবহার করা হয়। যেমন ক্যাডমিয়াম, লেড, টাইটোনিয়াম, ক্রোমিয়াম, নিকেল কপার ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। শহরে বছরে ৮.৫ লাখ টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পলিথিন উৎপন্ন হয়। ৩ লাখ টন প্লাস্টিক নদীর পাড় ও উপকূলীয় অঞ্চলের মাটির নিচে ও পাড়ে ফেলে দেওয়া হয়। দেশের শতকরা ৪০ ভাগ তরুণ প্লাস্টিক ব্যবহার করে থাকেন।”
এ সময় সবুজ আন্দোলনের পক্ষ থেকে নিম্নোক্ত উত্তরণের উপায়সমূহ প্রস্তাব করা হয়:
১. বিভাগীয় শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রোধে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করতে হবে।
২. রিসাইকেলিং প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে এবং আলাদা কমিশন গঠন করতে হবে।
৩. পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি ও ক্রেতা পর্যায়ে দাম কমানো এবং কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. সমুদ্র ,নদী ও জলাশয়ে প্লাস্টিক পণ্য ফেলা বন্ধ করতে হবে এবং সারাদেশের বাজার, পাবলিক প্লেস ডাস্টবিন নির্মাণ করতে হবে।
৫. পলিথিন উৎপন্ন হয় এমন সকল কারখানা বন্ধ করতে হবে।
৬. হোটেল, কাঁচা বাজারসহ সকল দোকানে পাটের ব্যাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৭. রাষ্ট্রীয়ভাবে জৈব প্লাস্টিক উৎপাদনে গবেষণা জোরদার এবং বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে গিয়ে স্টেকহোল্ডার বডি তৈরি করতে হবে।
৯. প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও সাধারণ জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।
অনুষ্ঠানে অতিথি আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.এ কে এম নজরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন, বাংলাদেশ প্লানার্স ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. আদিল মোহাম্মদ খান, আইন বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ও সবুজ আন্দোলনের উপদেষ্টা এ্যাড. আব্দুল কুদ্দুস বাদল । আরও বক্তব্য রাখেন সবুজ আন্দোলন পরিচালনা পরিষদের মহাসচিব মহসিন সিকদার পাভেল, পরিচালক ভাইস প্রিন্সিপাল নাদিয়া নূর তনু, নিলুফার ইয়াসমিন রুপা, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সহ-সভাপতি নুরুজ্জামান বাবু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সবুজ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ, সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক সমীরণ রায়, গণমাধ্যম বিষয়ক সম্পাদক মাহাবুব সোহেল। সঞ্চালনা করেন সবুজ আন্দোলনের পরিচালক অভিনেতা উদয় খান ও নারী পরিষদের সদস্য সচিব দিনা আমিন।
এ বছর গ্রীনম্যান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন স্থানীয় গাছের প্রজনন বৃদ্ধি ও মৃত্তিকা গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীন, বায়ু দূষণ ও পরিবেশ সচেতনতায় প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার গোলাম ইফতেখার মাহমুদ, নদী গবেষণা ও ঢাকা সিটির পরিবেশ সচেতনতায় রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ, সাংবাদিকতার মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে চ্যানেল ২৪ এর সিনিয়র রিপোর্টার মাকসুদ-উন-নবী, পরিবেশ সংক্রান্ত দুর্নীতি রিপোর্ট প্রকাশ ও পরিবেশ সচেতনতায় বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিক, ঢাকা সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের জীবন বৃত্তান্ত গণমাধ্যমে তুলে ধরায় বাংলা টিভি স্টাফ রিপোর্টার মোঃ শাহারিয়ার আল মামুন, গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন ও পরিবেশ সচেতনতায় মোহনা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার ঊষা ফেরদৌস এবং পরিবেশ গবেষণা ও জনসচেতনতায় বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখায় দৈনিক অধিকার’র ফিচার সম্পাদক সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার।
জাতীয় প্রেসক্লাবে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ছাড়াও সারাদেশের প্রায় ৪০টি জেলায় ও বেশ কয়েকটি দেশে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে।