করোনা অতিমারি কাল কাটিয়ে আবার মেরুদন্ড সোজা করে স্বাভাবিকতায় ফিরে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশ। করোনার প্রভাবে দেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিতে পতিত হয়েছে। পরিমাণ ও পুষ্টিগুণ বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিত ‘স্বাস্থ্যকর’ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পায় না দেশের ৪৩ শতাংশ মানুষ। দেশের মানুষের মধ্যে পুষ্টিকর খাদ্যের যোগান বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে গতানুগতিক প্রয়াসের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে, প্রনয়ণ করতে হবে যথাযথ আইনী কাঠামো।
এই প্রেক্ষাপটে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড ও ইয়ূথ এগেইনস্ট হাঙ্গারের আয়োজনে “নয়া স্বাভাবিকতায় পুষ্টি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ : মোকাবেলায় চাই আইনী কাঠামো” শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশের স্বেচ্ছাব্রতী যুব জাগরণী মঞ্চ ‘বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদ’ এর দ্বাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবার (৬ নভেম্বর) সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকাস্থ সিরডাপ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত এই যুব ছায়া সংসদে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ এর আদলে শতাধিক যুব সদস্য অংশ নেন এবং প্রস্তাবনার পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন।
সকলকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদের স্পীকার আমান্না জাহান বিভা দ্বাদশ অধিবেশন শুরু করেন।
এরপর অধিবেশনে শেরপুর-১ আসনের বিরোধী দলীয় সদস্য হাবীবা লিনা ১৪৭ বিধির অধীনে “নয়া স্বাভাবিকতায় পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চাই আইনি কাঠামো” শীর্ষক একটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন। সরকারি ও বিরোধীদল থেকে ১৮ জন সাধারণ আলোচনায় অংশ নেন।
অধিবেশনে জাতীয় সংসদের আদলে ৩৫০ জন যুব ছায়া সংসদ সদস্য অংশগ্রহণ করেন যার মধ্যে ১১২ জন সরাসরি এবং বাকিরা অনলাইনে যুক্ত হোন। ২২ টি সংগঠন যুব ছায়া সংসদের সহ-আয়োজক হিসেবে অংশগ্রহণ করে।
উক্ত প্রস্তাবের উপর সাধারণ আলোচনায় বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদ এর সরকারি ও বিরোধীদল থেকে মোন্তাহিনা হামিদ, নারায়ণগঞ্জ-৫, উম্মে ফারিহা নানজিবা, কুমিল্লা-৬, এম ডি জামাল হোসেন, লালমনিরহাট-২, উম্মে উমাইয়া তারিফ, কুষ্টিয়া-২, উম্মুল কুরা ফারিহা, চট্টগ্রাম- ৫, সাজ্জাদ আহমেদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬, জয়শ্রী সরকার, নেত্রকোণা-১, উং সাইন মারমা, বান্দরবান, মিথিয়া নাজনীন, নড়াইল-২, নওশীন জাহান নীহা, বগুড়া-২, হাজেরা সুলতানা, বরিশাল-২, শীপন মিয়া, মাদারীপুর-১, সানজিদা ইসলাম রূপা, ঢাকা-৮, খানসা রহমান, ঢাকা-৩, সিমু আক্তার ঢাকা-১৯, নীগার সুলতানা নিশাত নারায়ণগঞ্জ-৪ অংশ নেন।
বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী সিমু আক্তার বলেন, পুষ্টি নিরাপত্তার খাদ্য অধিকার আইন পাশ করতে হবে। টিসিবির পণ্য বিতরণকে রেশনিংয়ের আওতায় আনতে হবে, সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মিড-ডে মিল চালুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে, পুষ্টি নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো একটি আইনী কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে।
বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদের প্রধানমন্ত্রী নিগার সুলতানা নিশাত বলেন, আমরা একটি যুব পার্লামেন্ট গঠনের সুপারিশ করছি। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য জরিপ করে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন সময়ের দাবি।
যুব ছায়া সংসদ এর দ্বাদশ অধিবেশনের অতিথি পর্বে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন দেশের অন্যতম সিনিয়র সাংবাদিক ডিবিসি নিউজ চ্যানেল এর চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
তিনি বলেন, দেশের মোট জনশক্তিকে সম্পদে পরিণত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশের সকল যুবরা ঝাপিয়ে পড়েছিল তেমনি আজকে যারা তরুণ আপনারা যুদ্ধ করেননি কিন্তু খাদ্যযোদ্ধা হিসেবে দেশের সকল জনগণের পুষ্টি নিশ্চিত করণে আপনাদের মেধা, মনন, পরিশ্রম দিয়ে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্যের কথা সংবিধানেও উল্লেখ আছে আপনারাও নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য খাদ্য অধিকার আইন দাবি করছেন। আমিও একমত। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন না থাকলে আইনের কার্যকারিতা হারিয়ে যায়। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি কিন্তু অপুষ্টির সমস্যা রয়ে গেছে। বছরে ৩৭ লক্ষ টন খাদ্য অপচয় হচ্ছে আবার প্রতিটি মানুষের জন্য ২১২২ কিলো ক্যালরী অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। এসব সমস্যা সমাধানে যুবকদের মতামত ও ভাবনাগুলো গ্রহণ করা উচিত। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে যুব পার্লামেন্ট গঠনের দাবিকে সমর্থন জানাচ্ছি।
অতিথি হিসেবে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং বিসেফ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, গেইনের পোর্টফোলিও লিড মনিরুজ্জামান বিপুল, ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর আঞ্জুমান আখতার, ইয়ূথ ফোরাম বাংলাদেশের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট আলেয়া আক্তার লাকী।
শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও যুব ছায়া সংসদের উদ্যোক্তা সংগঠক আতাউর রহমান মিটন। আলোচনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইয়ূথ এগেইনষ্ট হাঙ্গারের সদস্য আদিবা কবির সৃষ্টি।
এছাড়াও তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান, এনডিসি এর পাঠানো শুভেচ্ছা বাণী ইয়ূথ এগেইনষ্ট হাঙ্গারের সদস্য তাহিয়া- তুল- জান্নাত (অবন্তী) পাঠ করে শোনান। তিনি তাঁর বাণীতে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যুব সংসদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা রয়েছে বিশেষ করে ব্রিটিশ ও জার্মানে। যুগোপযোগী বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির ব্যাপারে যুব সমাজকে সোচ্চার হতে হবে এবং নিজেদের মতামতকে অন্যের মতামতের সাথে বিনিময় করতে হবে। এছাড়াও ইয়ূথ এন্ডিং হাঙ্গার জাপানের পাঠানো ভিডিও বার্তা প্রদর্শন করা হয়।
অধিবেশনে দ্বিতীয় পর্বে দুপুরের পর ইয়ূথ এগেইনষ্ট হাঙ্গারের সভাপতি রাইসুল মিল্লাত সাফকাত এর সভাপতিত্বে “জাতীয় ভাবে যুব সংসদ গঠনের প্রয়োজনীতা” শীর্ষক যুব সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় ।
অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (বাস্তবায়ন) আব্দুল হামিদ, বাস্তব এর নির্বাহী পরিচালক রুহি দাস, ইয়ূথ নেক্সাসের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পলাশ মাহমুদ, হোপ ৮৭ এর কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ রেজাউল করিম বাবু, হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের ইয়ূথ কো-অর্ডিনেটর গাজী আনিকা আসলাম, ইয়ূথ এগেনইস্ট হাঙ্গারের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ আল কাইয়ূম কাফীসহ সারাদেশ থেকে আসা আরো অনেক তরুণ। সঞ্চালনা করেন ইয়ূথ এগেইনস্ট হাঙ্গারের সদস্য আজমেরী রহমান সিনথিয়া।
আলোচকরা বলেন, বাংলাদেশ যুব ছায়া সংসদ একটি অরাজনৈতিক, নির্দলীয় ও স্বেচ্ছাব্রতী মঞ্চ। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে প্রস্তাবিত জাতীয় যুব সংসদ কাজ করবে। যুব সমাজের পক্ষে এবং জাতীয় উন্নয়নের অন্যান্য ইস্যুতেও তারা মতামত তুলে ধরবে যা জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় প্রতিফলিত হবে।
পুরো অনুষ্ঠানটি ইয়ূথ এগেইনষ্ট হাঙ্গার বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।