যেভাবে রক্তাক্ত হয়েছিলো ‘আসাদের শার্ট’

এইচ মাহমুদ: আজ শহীদ আসাদ দিবস। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের হরতাল চলাকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে প্রথম শহীদ হন আসাদুজ্জামান। সে থেকে শহীদ আসাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

আসাদ ছিলেন নরসিংদীর সন্তান। দিবসটি উপলক্ষে নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ধানুয়া গ্রামের শহীদ আসাদের কবরে জিয়ারত ও পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।

শহীদ আসাদের পুরো নাম আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি ১৯৪২ সালের ১০ জুন হাতিরদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলহাজ্ব মাওলানা মোহাম্মদ আবু তাহের বিএবিটি হাতিরদিয়া সাদত আলী হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক।
আসাদ ১৯৬০ সনে মেট্রিকুলেশনের পর ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে বড় তিন ভাইকে অনুসরণ করে বিজ্ঞান পড়ার জন্য এইচএসসিতে ভর্তি হন এবং এক বছর লেখাপড়া করেন। পরে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজে ভর্তি হন। এ সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে বিএ (অনার্স) এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকা সিটি ল কলেজে এল.এল.বি কোর্সে ভর্তি হন। ফলাফল আশানুরুপ না হওয়ায় ঐ বছরেই দ্বিতীয়বার মানোন্নয়ন-মূলক এমএ পরীক্ষা দেন। কিন্তু জীবদ্দশায় এই পরীক্ষার ফলাফল আসাদ দেখে যেতে পারেননি।

১৯৬৯ সালে ১৭ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সমাবেশ থেকে ১১ দফা দাবিতে এবং ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ-ইপিআর বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি পূর্ণ দিবস হরতাল কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। এদিন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ডাকা হয়। গভর্নর মোনায়েম খাঁন ওই দিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন। ১১ দফা দাবিতে প্রায় ১০ হাজার ছাত্রের বিশাল মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে পুলিশি বাধার মুখে পড়ে। আসাদসহ কিছু ছাত্র ছত্রভঙ্গ মিছিলটি আবার সংগঠিত করে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময়ই পুলিশের গুলিতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়কে আসাদ শহীদ হন।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) গ্রুপ এর নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল শাখার সভাপতি আসাদের মৃত্যুতে আন্দোলনের অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে। শহীদ আসাদের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে পরদিন রাজধানী ঢাকায় বের হয় স্মরণকালের বৃহত্তম শোক মিছিল। বিক্ষোভের নগরীতে পরিণত হয় প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা। আসাদের রক্ত আর বিক্ষুদ্ধ জনতা সেই সময়ই ছুটে যান মোহাম্মদপুর তৎকালীন আইয়ূব গেটের সামনে এবং প্রতিবাদের ক্ষুদ্ধ প্রতীক হিসাবে আইয়ূব গেটের নামফলক গুড়িয়ে দিয়ে রক্ত দিয়েই লেখেন আসাদ গেট। সেই থেকে মোহাম্মদপুর আসাদ গেটের জন্ম।

ওই সময় আসাদের শার্ট হাতে নিয়ে জনতার দীর্ঘ মিছিল দেখে কবি শামসুর রাহমানও লেখেন তার বিখ্যাত কবিতা ‘আসাদের শার্ট’। ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্ত কবরীর মতো কিংবা সূর্যোস্তের জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট-উড়ছে হাওয়ায়-নীলিমায়।

এছাড়াও গণঅভুত্থানের নায়ক আসাদকে স্মরণীয় করে রাখতে তার জন্মভূমি নরসিংদীর শিবপুরে প্রতিষ্ঠা করা হয় সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ, শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাইস্কুল, শহীদ আসাদ সড়কসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু খোদ এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ নতুন প্রজন্ম শহীদ আসাদ ও তার রাজনৈতিক দর্শন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না।
প্রতি বছর শিবপুরের ধানুয়া গ্রামে শহীদ আসাদের সমাধিস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেন রাজনৈতিকরা।

ঊনসত্তরের এ গণআন্দোলনের সূত্র ধরেই ১৯৭১’র স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরু এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। পাঠ্যপুস্তকে রাষ্ট্রীয়ভাবে শহীদ আসাদের ইতিহাস তুলে না ধরার কারণে আসাদ সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম তেমন কিছু জানতে পারছে না বলে মনে করেন তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা ।

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts