বেদভিটা: যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ

সাকিরুল কবীর রিটন: চারদিকে থৈ থৈ পানি। বাড়িতে পানি, স্কুলে পানি। যে কেউ দেখলেই গ্রামটিকে মনে হবে এটা কোনো এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। শ শ বিঘা জমির মৎস্য ঘের বেষ্টিত গ্রামটির নাম ‘বেদভিটা’।

যে গ্রামের বাসিন্দারা উল্লেখযোগ্য নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান এমনকি মৃত্যুর পর স্বাভাবিক দাফন সম্পাদনও যাদের ভাগ্য থেকে সূদূর পরাহত।

অথচ সহজ-সরল মানুষের এ গ্রামটিতে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের যেন নাড়ির সম্পর্ক। একে অন্যের হৃদয়ের স্পন্দন বুঝতে পারেন। সব সুবিধাবঞ্চিত এ মানুষ গুলোর বেঁচে থাকার তাই প্রধান শক্তি ভালোবাসা, আবেগ আর শ্রদ্ধাবোধ। গ্রামবাসি এক নিবিড় বন্ধনে সব বঞ্চনার ক্ষত আড়াল করে হাসছে-খেলছে। বিনিময় করছে একে অন্যের সুখ-দুঃখ, ব্যাথা-বেদনা।

অভিশপ্ত ভবদহের কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ যাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। ভবদহের অভিশাপ যাদের জীবনের স্বাভাবিক গতিটুকুও নিঃশেষ করতে চায়। ভবদহের অভিশাপে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ গ্রামটিতে না গেলে বোঝার উপায় নেই শিল্প-বাণিজ্যের চরম উৎকর্ষতার যুগেও মানুষ কতটা অবহেলিত-বঞ্চিত জীবন যাপন করতে পারে।

‘বেদভিটা’ নামের এই গ্রামটির অবস্থান যশোরের অভয়নগর উপজেলার চলিশিয়া ইউনিয়নে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে সমৃদ্ধ নওয়াপাড়া থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে চলিশিয়া ইউনিয়নের আন্ধা, বলারবাদ ও বেদভিটা গ্রামটি একে অপরকে বেষ্টন করে আছে অপার মমতায়।

জানা গেছে, গ্রামটিতে মাত্র সাত শতাধিক লোকের বসবাস যার মধ্যে ভোটার আছেন মাত্র সাড়ে ৫শ। ২শ ২৫টি পরিবারে আবদ্ধ হয়ে তারা বাস করেন গ্রামটিতে।

একদিকে ভবদহের জলাবদ্ধতায় ফসলহীন বিল, অন্যদিকে নেই রাস্তাঘাট। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তালের ডোঙ্গা কিংবা ডিঙ্গি নৌকা। ফলে গ্রামটি সকল সুবিধা হতে বঞ্চিত।

গ্রামবাসি জানান, গ্রামটিতে অদ্যাবধি সভ্যতার নূন্যতম ছোঁয়া লাগেনি। যদিও এর মাঝে অনেকে জীবনের সাথে অনেক সংগ্রাম করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন। লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্মকর্তাও হয়েছেন কেউ কেউ। তবে সে সংখ্যা খুবই সামান্য।

গ্রামটিতে একটি মাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বেদভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে যাতায়াতের জন্য রয়েছে নামমাত্র রাস্তা। যা প্রায় সারা বছর পানিতে তলিয়ে থাকে। ফলে শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অনেকটা বেগ পেতে হয় অভিভাবকদের।

চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত এ গ্রামের মানুষকে চিকিৎসা নিতে পাশের দুইটি গ্রাম আন্ধা ও চলিশিয়া গ্রাম টপকে যেতে হয় চলিশিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় বা একাধিক বাশেঁর সাকো পার হয়ে তাদের সে পর্যন্ত পৌঁছাতে দেড়/দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। যে কারণে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ গাছ গাছড়া, লতাপাতাসহ টোটকা চিকিৎসায় নির্ভর করেন।

গ্রামটি থেকে অভয়নগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের বেশি। তার মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয় নৌকায় অথবা অসংখ্য বাঁশের সাঁকো পার হতে হয়। ফলে মুমূর্ষু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের হাসপাতালে আনা দূরূহ হয়ে পড়ে। অনেককে রাস্তার মাঝেই প্রাণ হারাতে হয়।

এক গ্রামবাসি দুঃখ করে বললেন, সভ্যতার এই যুগে তাদের কোন স্বজন মারা গেলে পড়তে হয় মহাবিপাকে। পানির জন্য লাশ দাফন করা কঠিন হয়ে পড়ে। আর হিন্দুদের সৎকার করতে বহুকষ্টে আনতে হয় ৫ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নওয়াপাড়া মহাশ্মশানে। ডিঙি নৌকায় লাশ আনতে গেলে পড়তে হয় নানা ঝামেলায়। এতে সর্বপ্রথম নিতে হয় ঘের মালিকদের অনুমতি। ঘেরের মধ্যেদিয়ে ডিঙি নৌকায় করে আনতে হয় মরদেহ। এত দূরাবস্থার মধ্যে থাকলেও বছরের পর বছর জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা বা আমলারা কেউ গ্রামবাসির এ দুর্দশা উঁকি দিয়েও দেখেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

বেদভিটা গ্রামের বাসিন্দা তৌহিদুল খান (৫২) প্রতিদিন ৪/৫ কেজি মাছ কিনে ব্যাগ ভর্তি করে সড়কবিহীন গ্রাম পাড়ি দিয়ে ৫ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আসেন নওয়াপাড়া বাজারে। সে গুলো বিক্রি করে যৎসামান্য যা পান তাই দিয়ে চলে তার সংসার। তিনটি ছেলে মেয়ে পড়ালেখা করছে তার।

সুকেশ মল্লিক নামে আরেকজন বাসিন্দা বললেন, গোটা গ্রামবাসীর চিত্রই এমন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের গ্রামের দুর্দশা আর কি বলবো, পশু-পাখিও এর চেয়ে ভালো জীবনযাপন করে। একটা মানুষ মরার পরও যে কষ্ট ভোগ করে সৎকার সম্পন্ন হয় সভ্যসমাজে তা বিরল।

দুইটি ছোট ছাগল নিয়ে ঘেরের পাড়ের উচু স্থানে ঘাস খাওয়াতে এসেছিলেন ওই গ্রামের গৃহবধু রুপবান। তিনি জানান, দুইটি ছাগল কোলে করে পানি পার হয়ে এখানে নিয়ে এসেছেন। ঘরে পানি, রাস্তায় পানি ছাগলগুলো না খেয়ে থাকে। আরো অনেক ছাগল ছিলো তা বিক্রি করে দিয়েছি। এদের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। রাতে খাটের উপর মানুষ গৃহপালিত ছাগল-মুরগী একসাথেই থাকতে হয়।

গ্রামের ৮০ বছরের বৃদ্ধ অতুল মল্লিক কাঁপা গলায় বলেন, যুগ যুগ ধরে আমাদের গ্রামটি অবহেলিত। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। এ গ্রামের মেয়েদের বিয়ে দেওয়াও দুস্কর হয়ে পড়ে। সভ্য সমাজের কেউ এ গ্রামটিতে আসে না। মারা গেলেও এতটুকু শান্তিতে সৎকার হয় না কারও। এর চেয়ে কষ্টের এর চেয়ে বিড়ম্বনার আর কি হতে পারে?

ছোট একটা ডিঙি নৌকায় ঘুরে গ্রামবাসীর খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন সদ্য নির্বাচিত ইউপি মেম্বর মানিক বিশ্বাস। তিনি বলেন, একজন সামান্য ইউপি সদস্যের কতটুকুই বা করার থাকে। তবুও গ্রামবাসীর সেবায় জীবনের বাকি সময় পার করবো। ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপিসহ সরকারি কর্তা ব্যক্তিদের কাছে বারবার ছুটে যাবো। তাদেরকে গ্রামে এনে দুর্দশার চিত্র দেখাবো। গ্রামটির জীবনমান ফেরাতে সবটুকু চেষ্টা করে যাবো। এভাবে কোন মানুষ বসবাস করতে পারে না।

 

Print Friendly

Related Posts