গ্রন্থপাঠ ॥ ফকির ইলিয়াসের ‘সাহিত‌্যের শিল্পঋণ’

সাহিত্য যখন শিল্পের কাছে দায় রেখে যায় ইরফানুল আবেদিন

কথাটি হতে পারতো, শিল্পব‌্যাংক। হতে পারতো শিল্প মন্ত্রনালয়। কিন্তু সাহিত্যে শিল্প !
আমরা যে শিল্পসম্মত সাহিত্যের কথা বলছি, তা কেমন সাহিত্য ? কেমন সংস্কৃতি ?
এমন কিছু প্রশ্নের জবাব নিয়েই একটি প্রবন্ধগ্রন্থ, ‘সাহিত‌্যের শিল্পঋণ’। লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসী কবি ফকির ইলিয়াস।
এই গ্রন্থে ছোট-বড় সতেরোটি প্রবন্ধ আছে। বিষয় হিসেবে লেখক বেছে নিয়েছেন-ব্যক্তিত্ব,সমাজ,গ্রন্থ,ভাবনা,মুক্তিযুদ্ধ,সংস্কৃতি ও জনমানস-কে।প্রথমেই বইয়ের সুচিগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। ক্রমগুলো এভাবেই সাজানো-
১। কবিতার গ্রহপথে হেঁটে যায় মৌন কাব্যকার
২।জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী : প্রজন্মের মননে ধ্যানী পুরুষ
৩।কাইয়ুম চৌধুরী : বাঙালীর চিত্রশিল্পের নন্দিত মুখ
৪। মুক্তিযুদ্ধের আলোয় কবিতার শক্তি,জাতিসত্তার উন্মেষের গতিধারা
৫।মননে প্রেমে ও প্রকৃতিতে রবীন্দ্রনাথের ছায়া
৬।সাহিত্যের পরিচর্যায় লিটল ম্যাগাজিনঃ আলোর বিদগ্ধ উন্মেষ
৭।শহীদ কাদরী’র দুটি কবিতার আলোছায়া
৮।মোহন রায়হানের কবিতা : দ্রোহের উন্মীলনে স্বপ্নের কারুচিহ্ন
৯।আমার চারপাশে জেগে থাকে ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম
১০।কবিতায় কথাশিল্পীদের দ্যুতির কোরক
১১।কবি কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার : প্রকৃতির উঠোনে কবিতার বরপুত্র
১২।ভাবনার জলগ্রহ ও সাহিত্যের জনমানস
১৩।কবিতার তৃতীয় বাংলা: আরশিতে আর্দ্র আরক
১৪।বাংলাদেশের আকাশ : কবিতায় শেখ মুজিব
১৫। সাহিত্যে শিল্প ও সৌন্দর্যের নান্দনিক ধারা
১৬।কবিতার জীবন ও কবিকৃতি শামসুর রাহমান
১৭। সাহিত্যের শিল্পঋণ, গ্রহীতার ভোরের জানালা

সূচির দিকে তাকলেই- একটি স্পষ্ট ধারণা পাবেন পাঠক, বইটি বিষয়ে। আর জানতে
পারবেন, এই লেখকের সময়কালে তার সাহিত্য দিনলিপির খণ্ডচিত্র।

[] দুই []
একজন বরেণ্য মানুষ তার প্রিয় দুপুরকে সাক্ষী রেখে যে ছবি শব্দছবি আঁকেন- সেটাই সাথী হয় পরবর্তী প্রজন্মের। তাদের একজন চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের চিত্রশিল্পকে একটি নতুন রূপ দিয়েছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ, গণমানুষের মৌলিক চেতনা,যাপিত জীবনচিত্রকে তুলে এনেছিলেন আন্তর্জাতিক নিরিখে। তিনি নিজের সৃজনকর্মে বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক বিষয় উপস্থাপন করেছেন। দেশীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাংলাদেশকে বিশ্বে তুলে ধরেছেন। তার মধ্যে ছিলো সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ বেদনার অন্তর্লীন মহাকাব্য।ছিল আমাদের গৌরবগাঁথা। তাকে নিয়ে এই লেখক লিখেছেন একটি প্রবন্ধ। এখানে মূলত কাইয়ুম চৌধুরীর কথাগুলোই লেখক জানাতে চেয়েছেন তার পাঠককে।

লোক শিল্প বিষয়ে কাইয়ুম চৌধুরী বলেছেন- ‘আমাদের লোকশিল্প পৃথিবীর যে-কোনো লোকশিল্পের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। বাংলার লোকশিল্প আমাকে শিল্পী করেছে। আমি অবাক হই গ্রামীণ শিল্পীদের কথা ভেবে, যাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই অথচ কী নিপুণ তাদের কাজ, কী নিপুণ তাঁদের রং নির্বাচন। গ্রামীণ শিল্পীরা তাদের ব্যবহার্য  জিনিস দিয়ে নিছক আনন্দের জন্য শিল্প রচনা করেন। তারা যে সমস্ত রং দিয়ে শিল্প তৈরি করেন তা আমাদের ভাবনার পরিসরকে বিস্তৃত করে। যেমন শখের হাঁড়ি, সরা তৈরিতে তাঁরা যে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন তা আমাদের চিত্তকে দোলা দেয়, মনকে জাগ্রত করে।
গ্রামীণ শিল্পীরা এক পাখিকে কতরকম রঙে যে রাঙিয়ে তোলেন! তাদের তৈরি রঙিন পাখি দেখে অবাক হতে হয়। পুরনো শাড়ির পাড় থেকে সুতো বের করে তা দিয়ে নকশিকাঁথা তৈরি করেন। এককথায় মিনিমাইজেশন অব অবজেক্ট, তা সত্যিই বিস্ময়কর। তাছাড়া গ্রামের শিল্পীরা কাঠের ঘোড়া, হাতি যেভাবে কাঠ কেটে তৈরি করেন, তা আমাকে আশ্চর্য করে। কাজের মাধ্যম এবং সময় এই লোকশিল্পীদের পরিমিতিবোধকে জাগ্রত করে।’
এই যে বোধ, তা আন্তর্জাতিক পাঠশালায়ও সমানভাবে সমাদৃত। ফকির ইলিয়াস তার জাতিসত্তার সেরা কিছু মানুষকেই উপস্থাপন করেছেন এই বইয়ে। ঠিক তেমনি আরেকজন প্রফেসর জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। বাংলাদেশে আজ যে রাজনৈতিক অরাজকতা চলছে- সে বিষয়ে খিব খোলামেলা কথা বলে গেছেন এই প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব।
তিনি বলেছেন- ” মানুষের প্রত্যাশা ঠিকই আছে। তাদের প্রত্যাশা হলো দেশে সুশাষণ ও আইনের শাষণ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু সু শাসনটা যে কি জিনিস সেটা এখানে তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে। তাই তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। সুশাসন বলতে আমরা যা বুঝি সেটা মোটামুটি হলো দেশে আইনের শাষন প্রতিষ্ঠা। কিন্তু দুঃখের বিষয় দেশে এখনো আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়নি। তবে ব্রিটিশ আমল থেকেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেটা আর সম্ভব হয়নি। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দলগুলোর একটা বড় ভূমিকা থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর এই ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বিচার বিভাগকে নিরপেক্ষ হতে হবে। আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ হতে হবে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো বিচার বিভাগ ও আমলাতন্ত্রকে নিরপেক্ষ রাখতে পারেনি। দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের এই অতিগুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে তারা অকার্যকর করে ফেলেছে। যার ফলে প্রশাসনের সর্বস্থরে দলীয়করণ ও দূর্নীতিতে নিমজ্জিত। যার কারনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। জনগণের সর্বস্তরে এ কারণে একটা হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে। পরিপূর্ণভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হলেই কেবল এ হতাশা কাটতে পারে।”
এই বইয়ে কবিতা নিয়ে আলোচনা আছে ব্যাপকভাবে। রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী, মোহন রায়হান, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, এরকম আলোকিত কবিদের কবিতা নিয়ে যেমন আলোচনা আছে- তেমনি আছে কয়েকটি বই নিয়েও আলোচনা।
কথাশিল্পীদের লেখা কবিতা নিয়েও রয়েছে আলোচনা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সম্পাদিত একটি কাব্যগ্রন্থ ‘বাংলাদেশের আকাশ’ নিয়ে রয়েছে
একটি শাণিত আলোচনা।তৃতীয় বাংলা তথা ইংল্যাণ্ডে এই সময়ের বাঙালী কবিদের প্রকাশিত একটি বই নিয়েও আলোচনা করেছেন কবি ফকির ইলিয়াস।

[] তিন []

লিটল ম্যাগাজিন এই সময়ে একটি আলোচিত সাহিত্য মাধ্যম। এই বিষয়টি নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ আছে বইটিতে। ”সাহিত্যের পরিচর্যায় লিটল ম্যাগাজিনঃ আলোর বিদগ্ধ উন্মেষ”- শীর্ষক প্রবন্ধে কবি, তার দেখা অনেক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। বিবর্তন ঘটাতে চেয়েছেন তার ভাবনার আলোয়।

একটি প্রবন্ধে লেখক খুব কাছের সময়চিত্রের জাল বুনেছেন। তিনি ”আমার চারপাশে জেগে থাকে ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম”- প্রবন্ধে লিখছেন, ”যেখানে একটি বিশাল বটবৃক্ষ ছিল, সেখানে এখন গড়ে উঠেছে একটি ইমারত। ইটের দেয়ালে কেউ ছেটে দিয়েছে একটি পোষ্টার। বল সাবান আর ঢেউটিনের বিজ্ঞাপন দখল করে নিচ্ছে পথিকের চোখ। আমি সেই পোষ্টারের দিকে তাকাই। দেখি একটি স্কুলগামি শিশু পোষ্টারের কোণে নিজের অটোগ্রাফ দিচ্ছে। মানুষ তার স্বাক্ষর রেখে যেতে চায়। আমিও একসময় চেয়েছিলাম। চেয়েছিলাম এই গ্রামের সবুজ ধারণ করে থাকবে আমার ভালোবাসার স্মৃতি। আমার প্রেমিকার মুখ জেগে থাকবে এই নদীর টলমল জলে।
‘বাসিয়া’ একটি ছোট্ট নদী। সুরমা নদীর শাখা। সেই নদীর পাড়েই আমার গ্রাম। পুরানগাঁও। আদিপিতারা বলতেন, মানুষের পুরনো ভিটে ছিল এই গ্রামে সারি সারি। এর পাশাপাশি নতুন বসতি গড়ে মানুষ। তাই এই গ্রামটি পুরাতন স্মৃতিস্তম্ভ হয়েই থেকে যায়। সেই থেকে ‘পুরানগাঁও’। আমি গ্রামের পঞ্চাশ বছরের বাসিন্দা। না, ঠিক বললাম না। এই পঞ্চাশ বছর বয়সের প্রায় ত্রিশ বছর আমি কাটিয়েছি বিদেশে। বাকী সময়টুকু…। হায় সময়, তুমি আমাকে তোমার দাস করে রেখেছো স্বদেশে বিদেশে।”
একই প্রবন্ধে তিনি আরও লিখছেন- ” আমি একজন কাব্যকার । কবিতা লিখি। আপাততঃ আমার ঠিকানা নিউইয়র্ক। গ্রাম যে নিউইয়র্কে নেই, তা নয়। ইষ্টরিভার কিংবা হাডসন নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমি দেখেছি সবুজের স্বপ্ন নিয়ে যে দালানগুলো আকাশে হেলান দিয়ে জেগে থাকে সারা রাত, সেই দালানঘেরা শহরটিও একটি গুচ্ছগ্রাম। নিউইয়র্কের একটি কাউন্টি কুইন্স। সেই কুইন্স কাউন্টির ‘উডহ্যাভেন’ এলাকায় আমাদের বাড়ি। সবুজ বৃক্ষঘেরা আর ফরেষ্ট পার্কের পুষ্পশোভিত এই নগরটিকে আমি একটি গ্রাম বলেই বার বার ভাবি। পরিকল্পিত নাগরিক সুবিধা শহরেও গ্রামের আবহ তৈরি করতে পারে, তার প্রমাণ ইউরোপ আমেরিকার অনেক নগর।
মনে পড়ে এ সময়ের বহুল আলোচিত মার্কিন কবি ডব্লিউ এস মারউইনকে একটি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনি কবি না হলে, কী হতেন?’ ঝটপট উত্তর দেন কবি মারউইন। ‘আমি একজন কৃষক হতাম।’ চমকে উঠি। ‘হ্যাঁ, আমি কৃষি কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম আমার গ্রামে’- যোগ করেন মারউইন। আমার গ্রামটিকে তখন আমার কাছে আরও বেশি আপন মনে হয়। আমি গ্রামের ছেলে, এই গর্বে বুকটা ভরে যায়।”
ফকির ইলিয়াস চমৎকার গদ্য লিখেন।তা বইটি পড়লেই বুঝা যায়। তার বলার ধরণ পাঠককে কাছে টানে খুব সহজে।
আলোচিত বইটি প্রকাশ করেছে ঢাকার -অনুপ্রাণন প্রকাশন।১০৪ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য রাখা হয়েছে-২৩০ টাকা। বিদেশে সাড়ে নয় ডলার। উজ্জ্বল প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী তৌহিন হাসান। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন তার শিক্ষক মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী’কে।
ফকির ইলিয়াস তার চার দশকের লেখক জীবনে যেসব মহাজনের দেখা কিংবা সান্নিধ্য পেয়েছেন- এই বইটি সেই অভিজ্ঞতার অনুচ্ছেদ। পাঠক তার অনুচ্ছেদ গুলোর সাথে নিজেদের জীবনচিত্র মিলিয়ে দেখলে লাভবান হবেন- তা বলাই যায়।#

 

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts