ঢাবির ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্র রোকন উদ দৌলা ভেজালবিরোধী আন্দোলনে ইতিহাস সৃষ্টি করে নীরবে অবসরে।
ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টিকারী রোকন উদ-দৌলা সরকারি চাকরি থেকে নীরবে অবসর নিয়েছেন। গত বছর ৩১ ডিসেম্বর চাকরিতে ছিল তার শেষ কর্মদিবস।
ভেজাল খাবারের বিরুদ্ধে এখন মানুষের যে সচেতনতা তার শুরুটা হয়েছিল রোকন উদ-দৌলার হাত ধরে। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্রায় প্রতিদিন অভিযান চালিয়েছেন ভেজাল খাবার উৎপাদনের উৎসস্থলে।
হানা দিয়েছেন কারখানা থেকে কারখানায়। ভেজাল উৎপাদনকারীরা ভয়ে তটস্থ থাকতেন এই বুঝি দলবল নিয়ে গেটে কড়া নাড়ছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রোকন উদ-দৌলা!
কীভাবে জানতেন কোথায় ভেজাল খাবার উৎপাদন হয় দেশ রূপান্তরের এমন প্রশ্নের জবাবে রোকন উদ-দৌলা বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ আমাকে তথ্য দিতেন। কখনো চিঠিতে, কখনো সশরীরে মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেটের ১৬ নম্বর কোর্টে হাজির হয়ে ভুক্তভোগীরা জানাতেন। যাচাই-বাছাই করে, রেকি করে পুলিশ, বিজিবি, কখনো কখনো আর্মি নিয়ে পরদিন চলে যেতাম কারখানায়। ’
ভেজাল খাবার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের অনেক প্রভাবশালী জড়িত। তারা স্বাভাবিকভাবে নেননি রোকন উদ-দৌলার অভিযান। তারা চেষ্টা করেছেন, তদবির করেছেন তাকে থামানোর জন্য। কিন্তু ততক্ষণে গণসচেতনতা তৈরি হয়ে গেছে।
চাপে পড়ার পরও কেন আপনাকে থামানো যায়নি, কিসের তাগাদা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে? রোকন উদ-দৌলা স্মৃতি হাতড়ে বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষ যখন ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হচ্ছিলেন তখন দেশ ও জাতির স্বার্থে ভেজালবিরোধী অভিযান করেছি।
রোকন উদ-দৌলা ভেজালবিরোধী অভিযানে মামলা করেছেন ১ হাজার ৭১৮টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরও ২৪টি। জরিমানা করেছেন ৯ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ৪৭৫ জনকে, বন্ধ করেছেন ৩০০টি ভেজাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। নষ্ট করেছেন ২ হাজার ৪৮০ লিটার ফরমালিনযুক্ত দুধ, ৩৮ মণ ভেজাল ঘি, ৪৪৩ মণ বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত আম, ২০০ লিটার ৫০ শতাংশ পানিমিশ্রিত দুধ।
রোকন উদ-দৌলা বিসিএস (প্রশাসন) নবম ব্যাচের কর্মকর্তা। মেট্রোপলিটান ম্যাজিস্ট্রেসির পর তিনি বিএসটিআইর উপপরিচালক ছিলেন। হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অবৈধভাবে বসবাসকারী লাখো মানুষকে উচ্ছেদ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। কোনোরকম ঝামেলা না করে সংশ্লিষ্টদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন।
রাজউকের ম্যাজিস্ট্রেট, পরিচালক ও সদস্য পদেও ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন অতিরিক্ত সচিব হয়ে। সচিব হতে না পেরে তিন বছর একই পদে চাকরি করে নীরবে অবসরে যান গত ডিসেম্বরের শেষে। অবসরে কী করবেন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর ‘পড়াশোনা আর কনসালট্যান্সি। ’
রোকন উদ-দৌলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ১৯৮৪ ব্যাচের ছাত্র। সম্মান প্রথম শ্রেণি এবং মাস্টার্সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে প্রথম হন। এমফিল গবেষণারত অবস্থায় বিসিএস দিয়ে চাকরিতে যোগ দেন।
জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করেন, অভিযানে রোকন উদ-দৌলা হয়তো অনেক বেশি কড়া ছিলেন। মাছ, আম, দুধ, সেমাই, মিষ্টিসহ বিভিন্ন পণ্য ধ্বংস করেছেন। কিন্তু ভেজাল খাবার বিক্রি করতে দেওয়ার চেয়ে ধ্বংস করাই ভালো। গুটিকয় মানুষের লাভের চেয়ে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর তাই রোকন উদ-দৌলার কড়াকড়িতে দেশের মানুষের বিশাল উপকার হয়েছে। এ কঠোর অভিযানের ধারাবাহিকতাতেই খাদ্যে ভেজালের পরিমাণ অনেক কমে এসেছে। বাধ্য হয়ে ভেজাল কারবারিরাও এখন অনেক সাবধান।
রোকন উদ দৌলার নবম ব্যাচের ব্যাচমেট এবং এখনো প্রশাসনে চাকরি করছেন এমন একজন কর্মকর্তা তার সাফল্যটা ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘রোকন উদ-দৌলা এবং পরবর্তী ধারাবাহিক কিছু অভিযানে ভেজাল কিছুটা কমেছে বলে মনে হয়। মাছে বা ফলে ফরমালিন দেওয়ার কথা এখন আর তেমন শোনা যায় না। ’ আর এজন্যই তার নাম মানুষের মনে স্থায়ী হয়ে গেছে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা, ‘রোকন উদ-দৌলার আগেও দেশে অনেক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। কিন্তু তাদের কাউকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিনত না, মনে রাখা তো দূরের কথা। কিন্তু রোকন উদ-দৌলা নাম এখনো সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। ’