শাহ মতিন টিপু
স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজ ১০২তম জন্মদিন। একাত্তরের উত্তাল মার্চের ১৭ মার্চ ছিল এই মহান নেতার ৫২তম জন্মদিন। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর জাতির সামনে সেদিন এ দিনটি ছিল অনন্য এবং ব্যতিক্রম। সমগ্র জাতি সেদিন কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধুর শুভ জন্মদিনে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে।
সেদিন ছিল বুধবার, লাগাতার চলা অসহযোগ আন্দোলনের ষষ্ঠদশ দিবস। এমন অগ্নিগর্ভ সময়ে সকাল থেকেই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা এবং দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জমায়েত হতে থাকেন।
অন্যদিকে এইদিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমন্ডির বাসভবনে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২তম জন্মদিনে আপনার সবচেয়ে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’
-উত্তরে বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি।’
এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে চলে জাতির কাণ্ডারিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন। এসময় তিনি বেদনার্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না- আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এ দেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যে কোন মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কি, আর মৃত্যুদিনই কি? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’
এ দিকে আজ ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নির্ধারিত দ্বিতীয় দিনের বৈঠক। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া ১ ঘণ্টার এ বৈঠকেও তৃতীয় কোন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। বৈঠকটি ছিল স্বল্পস্থায়ী। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বের হয়ে আসলে সাংবাদিক ও আলোকচিত্রীরা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ধরেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার নাই। আরও আলোচনা হতে পারে, তবে বৈঠকের সময় এখনও ঠিক হয় নাই। আজও হতে পারে, আগামীকালও হতে পারে।’
আজকের আলোচনা-বৈঠক এত সংক্ষিপ্ত হলো কেন? এক সাংবাদিকের এই প্রশ্নের জবাবে নিরুত্তর থেকে বঙ্গবন্ধু মৃদু হেসে নীরব থাকেন। তখন এক বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, আমরা কী এই হাসি থেকে কিছু অনুমান করে নিতে পারি।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনার মুখেও তো মৃদু হাসির রেখা। আমি জাহান্নামে বসেও হাসতে পারি।’
আরেক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি সুখী না অসুখী? বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেন, ‘আমি তো বলেছি নরকে বসেও আমার চিত্তে সুখের অভাব ঘটবে না। আমার চেয়ে বেশি সুখে আর কে আছে ? সাত কোটি মানুষ আজ আমার পেছনে পাহাড়ের মতো অটল। আমার জনগণ আমাকে যা দিয়েছে তার তুলনা নাই।’
বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আপনার বাসভবনে আসার পরিবর্তে আপনি প্রেসিডেন্ট ভবনে গেলেন কেন? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ভবনটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতেই অবস্থিত। আর বাংলাদেশের সব ঘরই আমার ঘর।’
বিদেশি আরেক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সব কিছু আছে। বাংলার অবারিত মাঠ, উদার আকাশ, উর্বর পলির নদী, সোনালি ফসল পাট, ইক্ষু, তামাক, চা, মিঠাপানির মাছ, সুপেয় জলাধার, বিরাট কর্মক্ষম জনশক্তি- সব আছে আমাদের। আমরা চাই শুধু ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান। আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই।’ এ কথাগুলো বলার সময় বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল।
এদিন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ অফিসে এক দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। এছাড়া বায়তুল মোকাররমে আসরের নামাজের পর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশেষ মিলাদ ও দোয়ার আয়োজন করা হয়।