এখনো ঘুমের ঘোরে আতঙ্কে আঁতকে ওঠেন তারা

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার অমানবিক ঘটনাকে বর্ণনা করা যায় না। সতের বছর আগে আওয়ামী লীগের জনসভায় অনেক নেতাকর্মী নিহত হন। আর সেই হামলায় যারা আহত হয়েছেন তারা শরীরে স্প্রিন্টার নিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের সঙ্গে দিন কাটান। এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে আতঙ্কে আঁতকে ওঠেন তারা।

সতের বছর আগে আওয়ামী লীগের জনসভায় নারকীয় সেই একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে বছরের পর বছর জীবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে এখন ক্লান্ত রাশিদা আক্তার রুমা। শরীরের ভেতরে বাস করা স্প্রিন্টারের যন্ত্রণা বোঝাতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা সেদিন বোধহয় মরে গেলে বেঁচে যেতাম। আমরা সেদিন মরে গেলে তাহলে আমার বাচ্চারা আমার পরিবারের এতো হয়রানি, এতো কষ্ট করতে হতো না।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর থেকে প্রচণ্ড শারীরিক-মানসিক যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন জানিয়ে রুমা জানান, এখন শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপের দিকে। ডাক্তাররা বলেন, কিডনিতে সমস‌্যা হয়েছে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন ভুক্তভোগী মিলে অনুরোধ জানিয়েছি উন্নত চিকিৎসার জন‌্য বাইরে পাঠানোর জন‌্য। দুই-চারটি অপারেশন আছে, এটি করা না হলে আমার শরীরে ইনফেকশন হয়ে যাবে। আমার শরীরের ভেতর যে রডগুলো আছে, তা বের করা হয়নি। আর গ্রেনেডের স্প্রিন্টার বের করতে হলে জার্মান যেতে হবে।

‘বাংলাদেশ তো কোনো চিকিৎসা নেই। ওষুধ খেয়ে খেয়ে স্প্রিন্টারগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে। আমাদের অপারেশন না হওয়াতে কিছুদিন আগে সেলিম ভাই (২১ আগস্টে আহতদের অন্যতম) মারা গেছেন….এভাবে আমাদের ৭/৮জন মারা গেছে। যারা ২১ আগস্টের ভুক্তভোগী,” জানান তিনি।

সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ওইদিন সমাবেশে জয় বাংলা বলে আপা (শেখ হাসিনা) নামতে যাবেন এমন সময় বিকট শব্দ। এরপর কোথায় যেন উড়ে গিয়ে পরলাম। কখন, কতক্ষণ ছিলাম জানি না। সন্ধ্যার দিকে আমার কানে কোলাহলের শব্দ এলো। তখন আমি চোখ খুলে দেখি রক্ত আর রক্ত। আমার আঙ্গুল, বা হাত, দুটো পা ভেঙে গিয়েছিলো। পা ভেঙে হাড় বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলো। হাতির পায়ের মতো ফুলে গিয়েছিলো আমার পা দুটো।

‘পরে আমি আমার বাম হাতের ওপর ভর দিয়ে কোনো রকম উঠে দেখি আইভি আন্টি ওখানে পড়ে আছে। আমি ওনার পাশেই ছিলাম। আমি উঠে যে কাউকে কিছু বলবো তা পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর মাথা ঘুরে পড়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। পরে কেউ একজন আমাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।’

রুমা বলেন, ২৪ ঘণ্টা ওষুধ খেয়ে থাকতে হয়। প্রতিটা দিন ৩০-৩৫ টা ট‌্যাবলেট খেতে হয়। এই যে স্প্রিন্টার শরীরে প্রচণ্ড জ্বালাপোড়া করে। দিনে ৪/৫বার গরম পানি করে শরীরে ঢালতে হয়। না ঢাললে পোকার মতো হাটতে শুরু করে। চুলকাতে চুলকাতে রক্ত বের হয়ে যায়। গরমের দিন আসলে এটা হয়। রাতে যন্ত্রণা করে খুব বেশি। পা অবশ হয়ে যায়।

‘আমরা সেদিন বোধহয় মরে গেলে বেঁচে যেতাম। আমরা সেদিন মরে গেলে তাহলে আমার বাচ্চারা এতো হয়রানি কষ্ট করতে হতো না।’

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত আরেকজন নাজমুল হাসান নাজিম, যিনি ওই সময়ে ভৈরব উপজেলা যুবলীগের সহ সম্পাদক ছিলেন। বীভৎস সেই হামলায় চোখের সামনেই মৃত‌্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন প্রয়াত আইভী রহমানকে। তাকে বাঁচাতে তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও গ্রেনেড আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যান নিজেও। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান রাস্তায়। তারপর আর কিছু মনে নেই, বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন। সবাই মনে করেছিলো তিনি মারা গেছেন।

একুশে আগস্টের ভয়াবহ সেই দিনের ঘটনা মনে করে এভাবেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন তিনি। কতটা ভয়ঙ্কর ছিলো সেই দৃশ‌্যপট তা বলতে গিয়ে বারবার শিউরে ওঠেন নাজমুল। শরীরে মধ‌্যে থাকা শত শত স্প্রিন্টারের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে আছেন জীবনযুদ্ধে।

‘আসলে স্প্রিন্টারের জ্বালা কি, কতো কষ্টের তা বলে বোঝানো যাবে না। যার শরীরে স্প্রিন্টার বিধেছে সেই অসহ‌্য এই যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারে।’

এখন শরীর কেমন, কিভাবে চিকিৎসা চলছে জানতে চাইলে নাজমুল জানান, ‘শরীরে অনেক স্প্রিন্টার আছে এখনো। ১০-১২টা অপারেশন শুধু আমার পেটেই হয়েছে। পরে পায়ে হয়েছে। দেশের বাইরে আপা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) বিদেশ থেকে উন্নত চিকিৎসা করিয়ে এনেছিলেন। পরে স্প্রিন্টারগুলো আর বের করা হয়নি।’

গত ১৭ বছরের যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে বেঁচে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘২০০৪ থেকে খুব কষ্টে আছি। এসব চিকিৎসা দেশের বাইরে ছাড়া হবে না। সবগুলো স্প্রিন্টার বের করা যাবে না। যার শরীরে গ্রেনেডের স্প্রিন্টার ঢুকেছে সেই বোঝে কি কষ্ট। মাঝে মাঝে শরীর অবশের মতো হয়ে যায়। যেখানে স্প্রিন্টার আছে গরম এলে সেখানে খুব চুলকায়।’

ব‌্যথার ওষুধ খেতে খেতে কিডনিতে সমস‌্যা হয়ে গেছে জানিয়ে নাজমুল হাসান নাজিম বলেন, ‘ওষুধ না হলে আর চলা যায় না। ব‌্যথার কারণে ট‌্যাবলেট খাওয়ার কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডাক্তার বললো যে এই ট‌্যাবলেট আর খাওয়া যাবে না। আমি এখন কিডনি নিয়ে বড় সমস‌্যায় আছি।’

চিকিৎসা করতে করতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অধৈর্য হয়ে গেছি…আসলে কি দিয়ে কি কিরবো। আপা আসলে অনেক চেষ্টা করেছে, আমাদের জন‌্য অনেক করেছেনও তিনি। উনি ওই সময়ে উন্নত চিকিৎসা না করালে আজকে আমি হয়তো এই অবস্থায় থাকতাম না। গুরুতর আহত ২২ জনের মধ‌্যে সবাই জানতো আমি মারা গেছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি বেঁচে আছি।’

সেদিনের ঘটনার ভয়াবহতা স্মরণ করে নাজমুল বলেন, ‘গ্রেনেডের আঘাতে আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়, পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এখনও পা প্লাস্টার করা। বিভিন্ন জায়গা থেকে মাংস এনে পায়ের ক্ষতগুলো পূরণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।’

স্প্রিন্টারের কারণে হাঁটাচলা ঠিকমতো করতে পারেন না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বড়জোড় একশ দুইশ হাত গেলেই আর পা চলে না। আমাবশ‌্যা পূর্ণিমায় প্রচণ্ড ব‌্যথা হয় সহ‌্য করা যায় না। যাদের গায়ে স্প্রিন্টার লেগেছে তারা ছাড়া এর যন্ত্রণা কেউ বুঝবে না।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেই নারকীয় হামলায় আহতদের একজন তৎকালীন ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মাহবুবা পারভিন। ওই ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে ছিলেন তিনি। মৃত্যুর সাথে লড়েছেন। বাঁচবেন কি না তা নিয়ে তখন ছিলো শঙ্কা।

‘উন্নত চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয় আমাকে। পঁচিশ দিন পর আমার জ্ঞান ফেরে। কলকাতায় যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন থেকেই প্রতিদিন প্রতিক্ষণ যন্ত্রণা ভোগ করছি। এমন কষ্ট যে, চিৎকার করে কেঁদেছি। সেই থেকে আজ অবদি গত ১৫ বছর একটি রাতেও ঠিকমত ঘুমাতে পারি না’, বলছিলেন পারভিন।

২১ আগস্টের রক্তাক্ত হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ জনে। গ্রেনেড হামলার পর সেদিন রাজধানীর প্রতিটি হাসপাতালে আহতদের তিল ধারণের স্থান ছিল না।

ভয়াবহ বীভৎস সেই ক্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখে মুখে আতঙ্ক ভর করে পারভিনের।

কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার এক সাইড প্যারালাইসড হয়ে গিয়েছিলো। বাম হাত, বাম পা অবশ হওয়ার কারণে আমাকে দাঁড় করাতে পারেছিলো না। স্বেচ্ছসেবক লীগের প্রচার সম্পাদক আশীষ কুমার মজুমদার আমাকে সেখান থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। আমার ভাই যখন ডাক্তারের কাছে আমার অবস্থা জানতে চাইলেন তখন ডাক্তার বলেছিলেন উনি বেঁচে আছে না কি মরে গেছে তা ৭২ ঘণ্টা পর বোঝা যাবে।’

এতো বছরেও শরীরের ভেতরে থাকা স্প্রিন্টারের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না জানিয়ে রুমা বলেন, ‘মাঝে মাঝেই রাতে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। পায়ের মধ্যে স্প্লিন্টারগুলো কাটার মতো বিধে। যন্ত্রণা সইতে না পেরে নিজেই ব্লেড দিয়ে পা কেটে স্প্লিন্টার বের করতে চেয়েছিলাম। প্রতিনিয়ত মৃত্যু যন্ত্রণা বয়ে চলেছি।’

চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং সার্বিক খোঁজখবর রাখায় দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান মাহবুবা পারভিন। তিনি বলেন, ‘ওই হামলায় তিনি নিজের (শেখ হাসিনা) কথা চিন্তা না করে আমাদের চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন, নির্দেশনা দিয়েছেন, খোঁজ নিয়েছেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন।’

একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার পর শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন তাদের জীবন কিভাবে চলছে। কতটা যন্ত্রণা, কষ্ট নিয়ে প্রতিটি দিন পার করেন তারা। প্রতিদিনই আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই, বলেন মাহবুবা পারভিন।

Print Friendly

Related Posts