গড়ে উঠেছে পানীয় ফসলের জার্মপ্লাজম সেন্টার
টিলাঘেরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাসের ২টি টিলায় শুরু হয়েছে চা নিয়ে গবেষণা। দুই একর জায়গা নিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম এই অর্থকরী ফসলের চাষ ও গবেষণা চলছে। গত তিন বছর ধরে তিল তিল করে এই চা বাগান গড়ে তুলেছেন কৃষি অনুষদের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগের প্রফেসর ড. এ.এফ.এম. সাইফুল ইসলাম।
সকালের সোনালী আলোতে চা বাগানে ঢুকতেই উঁচু নিচু সবুজ ল্যান্ডস্কেপ মনকে তরতাজা করে দেয়। এই ভাদ্র মাসে ছায়াগাছ দিয়ে আবৃত চা বাগান কচি কশিলয়ের ঘ্রাণে মো মো করছে। বোঝাই যাচ্ছে চায়ের পাতার তোলার উপযুক্ত সময় চলছে। ছায়াগাছের গোড়ায় গোড়ায় লাগানো গোলমরিচ ও খুলনা বিভাগের বিখ্যাত চুই ঝাল গাছ লতে বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।
শুধু চা নয় কফি গাছেরও দেখা মিললো বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি চা বাগানে। পানীয় ফসলের এই বাগানে আরো রয়েছে লেমন ঘাস ও তুলসি। প্রফেসর সাইফুল জানিয়েছেন এগুলো চায়ের মূল্য সংযোজন করে। আরো রয়েছে কাজু বাদাম। এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান থাকার কারণে চা নিজেই অষুধী গাছ। তুলসী, বাদাম এবং লেমন ঘাস এর ঘ্রাণ ও মানের সাথে ওষুধি গুণাগুণও বাড়িয়ে দেবে।
চা গাছের যেমন কচি পাতায় এেেসছে কফি গাছেও এসেছে থোকায় থোকায় ফল। ঈড়ভভবধ অৎধনরপধ ও ঈড়ভভবধ ৎড়নঁংঃধ এই দুই জাতের কফির গবেষণা চলছে এখানে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে কফির চারা সংগ্রহ করা হয়। চাষ ব্যবস্থাপনা, জাত নির্বাচনের তারতম্যে কফি উৎপাদনে কী প্রভাব পড়ছে সেটি দেখাই মূল উদ্দেশ্য। এছাড়াও ফল সংগ্রহের সময় এবং বেকিং টইম কম বেশি করে কফির উৎপাদন ও মান বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণা চলছে।
ড. সাইফুল বলেন, “পাট শিল্প, চিনি শিল্প ইতোমধ্য নিঃশেষ হয়ে গেছে, চা শিল্পের বিরুদ্ধেও ষরযন্ত্র চলছে। গ্রাম থেকে শহর আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয় পানীয় চা। বাংলাদেশে দিনদিন এর চাহিদা বেড়েছে কিন্তু উৎপাদন সে অনুপাতে বাড়েনি। চাহিদার কথা মাথায় রেখে সরকারকে ২০১৫ সাল থেকে বাইরের দেশ থেকে চা আমদানী করতে হচ্ছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫ মাস খরার সময় বাংলাদেশে চা পাতা তোলা যায় না। তাই সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চা বাগানে ড্রট টলারেন্ট ভ্যারাইটি বা খরা সহিষ্ণু চায়ের জাত উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া চলছে।” তিনি জানান, একজন পিএইডি ছাত্র তার সাথে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে গবেষক দলটি, দেশ বিদেশের বিভিন্ন বাগানের সেরা সেরা চায়ের চারা সংগ্রহ করেছে। সেচের পরিমান কমিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে চা গাছ টেকানো যায় কি না, তা পরীক্ষা করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাইট (পাতার রস খেয়ে ফেলে এক ধরণের ক্ষুদ্র পোকা) এবং অন্যান্য পোকা চা পাতার কি কি ক্ষতি করছে সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে এবং মাইট ও পোকা সহিষ্ণু চায়ের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে দু প্রকার চায়ের চাষ হয়। একটি চীনের চা বা ক্যামেলিয়া সাইনেসিস, আরেকটি আসামের চা বা ক্যামেলিয়া আসামিকা। সিলেট এক সময় ভারতের আসাম অঞ্চলেরই অংশ ছিলো। সিলেট ও আসামের ভূপ্রকৃতি এবং আবহাওয়া প্রায় একই রকম। তাই সিলেটের উপত্যকায় আসামিকা চায়েরই উৎপাদন বেশি। স্ট্রং মল্ট ফ্লেভার এবং বড় দানার জন্য এর চাহিদা ব্যাপক। আসামের টোকলাই চা গবেষণা কেন্দ্র থেকে আনা হয়েছে বিশেষ প্রজাতির ৯টি জাত। তবে গবেষক ড. সাইফুল মানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিটি-২ চা কে এগিয়ে রেখেছেন।
তিনি বলেন, বিটি-২ এর পপুলেশন ডেনসিটি (স্থান অনুযায়ী গাছের আধিক্য) সামান্য বাড়িয়ে দিলেই মোট উৎপাদন বেড়ে যায়। তিনি প্লান্ট স্পেসিং (এক গাছের থেকে আরেক গাছের দূরত্ব) কমিয়ে বিটি-২ চাষ করতে চা বাগান মালিকদের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, পাতা বড় দেখে অনেকে আসামিকা জাত চাষ করে থাকেন। কিন্তু মানের দিকে বাংলাদেশী জাতগুলোই সেরা। উৎপাদন বাড়াতে তিনি একশ বছরের বুড়ো চা গাছগুলোকে রিপ্লেস করার জন্য টি স্টেটগুলোকে অনুরোধ করেছেন।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চা বাগানে ৯ প্রজাতির ভারতীয় টোকলাই প্রজাতির চা গাছ ছাড়াও, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিটি-১ থেকে বিটি-২২ পর্যন্ত ক্লোনগুলো চাষাবাদ হচ্ছে। সাথে রয়েছে ১টি বাইক্লোনাল ভ্যারাইটি ও ৪টি বাংলাদেশী বাগানের ক্লোন। ল্যাটিন স্কয়ার ডিজাইনের এই গবেষণা মাঠ থেকে প্রতিদিন ২৪ টি প্যারামিটারে তথ্য সংগ্রহ চলছে।
চা শিল্পের বেহাল দশা নিয়ে গবেষক ড. সাইফুলের কিছু আক্ষেপ রয়েছে। তিনি বলেন, “আমি প্রায় ৩০টিরও বেশি বাগান পরিদর্শন করে দেখেছি, চা উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় চা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন এমন লোক নেই। বাগানগুলোতে দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ হচ্ছে না বিধায় আজ চা শিল্পের বেহাল দশা। চা উৎপাদনশীলতা, চা গাছের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও মান নিয়ন্ত্রনের জন্য অবশ্যই কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা গ্রাজুয়েট লাগবে।” সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষ না থাকলে একসময় এ শিল্পটি মুখ থুবরে পড়তে পারে বলে এই গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রতিটি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপক পদে উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কৃষিবিদ নিয়োগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সিকৃবি জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর জানায়, ক্যাম্পাসের এই ছোট্ট চা বাগানটি প্রাথমিক অবস্থায় এনএটিপির প্রজেক্ট ছিলো। পরবর্তীতে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এখন বড় একটি জার্মপ্লাজম স্থাপিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও চা উৎপাদন প্রযুক্তি বিভাগ ও কীটতত্ত¡ বিভাগ এই গবেষণায় সরাসরি যুক্ত হয়েছে। প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. এ.এফ.এম. সাইফুল ইসলাম ছাড়াও এই গবেষনায় যুক্ত রয়েছেন প্রফেসর ড. মোঃ আব্দুল মালেক এবং রশীদুল হাসান।
সূত্র: খলিলুর রহমান ফয়সাল, উপ পরিচালক-জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।