আতাতুর্ক কামাল পাশা
বাইশের সাহিত্য নোবেলটি ঘরে তুললেন অ্যানি এরনো। ১৯৪০ সালে ডিসেম্বরের প্রথম দিনটিতে তার জন্ম ফ্রান্সের নরম্যন্ডির ইভেতোতে। নোবেল কমিটি সাহিত্যে নোবেল দেবার জন্য যখন তার নাম ঘোষণা করছিলেন তখন নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসন বলেন, সাহস এবং সুক্ষ্ম ব্যবচ্ছেদের বা বিচারের তীক্ষ্ণ মেধায় তিনি স্মৃতির শেকড়, বিচ্ছিন্নতা এবং সম্মিলিত সংযম নিপুণভাবে উন্মোচন করেছেন।
অ্যানি এরনোর আগেও পোল্যান্ডের তোকারজুক, লুক্সেমবার্গের এলফ্রিদে এলিয়েনেক, কানাডার এলিস মুনরোকে সাহিত্যে নোবেল দেয়া হয়। তোকারজুক একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় তার ফিকশনগুলো লিখে যান। এখানে তিনি নির্দিষ্ট মানচিত্রের, নির্দিষ্ট সীমানার বাইরে যেতে পেরেছিলেন এবং সুন্দর সামঞ্জস্য রেখে অতীত থেকে বর্তমানে আসতে পেরেছিলেন। এলফ্রিদে এলিয়েনেক বনেদী জার্মান ভাষায় সুন্দর লেখা লিখেছিলেন যদিও পরবর্তী নোবেল পাওয়া নাট্যকার পিটার হ্যান্দেকে তাতে নাক সিঁটকেছেন। এলিস মুনরো বহু প্রাচীন রীতি ইংরেজী গথিককে (এড়ঃযরপ) একটি ভিন্ন এবং নতুন ধারায় উপস্থাপন করেন। কাজুয়ো ইশিগুরোও সময়ের সার্বজনীনতা নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু এবার অ্যানী এরনো আনলেন একটি চর্চিত, যত্নের সাথে ছেঁকে নেয়া, কর্ষিত, সুনির্বাচিত ফিকশন বা মুক্ত গদ্য। বিশ্বে সভ্যতা সৃষ্টির বহকাল ফরাসীদের সাথে বিলেতীদের সংঘর্ষ বেঁধেই ছিল। ফরাসীদের দাবী, বিশ্বে তারাই আগে সভ্য হয়েছে, শিক্ষিত হয়েছে, পৃথিবীতে তাদের নাম ছড়িয়েছে। বিলেতীরা দাবী করত, না। তারাই আগে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে আসে। বিশ্বে শিক্ষার আলোক তারাই ছড়িয়েছে। বিশ্বের সেই প্রথম সারির সভ্য জাতির একজন অ্যানী এরনোকে পুরস্কার দেবার সময় কয়েকবার কমিটির চেয়ারম্যান, বিচারক বা বিশ্লেষকদ্বয় বলতে থাকেন, তিনি সাহিত্যকে সাহিত্যের মর্যাদায়, ফিকশনকে দায়িত্বপূর্ণভাবে এবং সাহিত্যকে একটি উন্নততর দর্শনের পর্যায়ে এনেছেন। এটাই তার বিশেষ দিক।
গত কয়েক বছর ধরে তোকারজুক, এলফ্রিদে এলিয়েনেক, এলিস মুনরো, মারিও ভার্গাস ইয়োসা সাহিত্যকে সাহিত্যের মর্যাদা দিয়ে এ মাঠটাকে কর্ষণ করে আসছেন। সাহিত্যের ধারাটিকে ভিন্নভাবে ফিকশনে, নন-ফিকশনে তুলে ধরেছেন। তবে মার্কিন লেখিকা লুইস গ্লুক বা ব্রিটেনের নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার যে আভিজাত্যবোধে বা সুপারিশে নোবেল পেয়েছেন বলে অধিকাংশের ধারণা, তাদের এ বিশ্লেষণের মাঝে আনছি না। কিন্তু এটি ঠিক, তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে সাহিত্যকেও উন্নত, চর্চিত, কর্ষিত বোদ্ধায় আনার চেষ্টা অনেকেই করছেন ইদানিং। তাদের মধ্যে অ্যানি এরনোকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করা যায় নিঃসন্দেহে। এখন পর্যন্ত তার কুড়িটি বই পাঠকদের হাতে এসেছে। তার লেখায় ধারাবাহিকভাবে এবং বিভিন্ন কোণ থেকে, লিঙ্গ, ভাষা এবং শ্রেণী সম্পর্কিত শক্তিশালী বৈষম্য দ্বারা চিহ্নিত একটি জীবনকে যুক্তি ও বাস্তবতা দিয়ে পরীক্ষার করার কঠিন শ্রমকে মূল্যায়ীত করা হয়েছে এবারের নোবেলদাতাদের চোখে। এমনও বলা হচ্ছে, এ পথে তিনি একা। কতদূর তিনি এগোতে পারবেন এটিই এখন দেখবার বিষয়। তিনি নিজের জীবন এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে মাইক্রোসকোপিক চোখে পরীক্ষা করেছেন। তবে তার ভাষা সংক্ষিপ্ত এবং সহজ ও তীর্যক। তিনি নিজকে “নিজের নৃতাত্বিক” হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি সাহিত্যকে সাহিত্যের মূল্যবোধের চেয়েও আরো একটু বেশি এগিয়ে নিতে পেরেছেন যা অন্যান্য নোবেল সম্মানীত লেখকদের থেকে কিছুটা আলাদা করবেই।
প্রলেতারিয়েত সমাজ ব্যবস্থা থেকে তার পিতা-মাতা তাদের পরিবারকে যে বুর্জোয়া শ্রেণীতে উঠিয়ে নিয়ে আসেন, সেটি সমাজ ব্যবস্থার উন্নতিতে না দেখে তিনি রাজনীতিকে বেশি গ্রাহ্য করেছেন। তার সাহিত্যকর্মে ফরাসী মহাকবি মার্সেল প্রুস্ত-এর প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু অ্যানি এরনো নিজকে ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দ্যু-র আলোয় উদ্ভাসিত নৃতাত্বিক হিসেবে মনে করেন।
তার উপন্যাসগুলো সহজ সরল ভাষায় লেখা। তবে বক্তব্য খুব তীর্যক। তার দৃষ্টিতে মানুষ, নারী, পরিবার যেভাবে উঠে আসা প্রয়োজন ছিল, সেভাবে উঠতে গিয়ে বা এগিয়ে আসতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে প্রতিনিয়ত বাধা পাচ্ছে। আর এটি নিয়েই তার কাজ। তিনি এই অবস্থানের বিরোধীতা করে এগিয়ে যেতে চান।
তিনি নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান অ্যান্ডার্স ওলসনের মতে সাহিত্যকে পরিপূর্ণভাবে, নির্জলা টলটলে পরিস্কার পানির মতো সাহিত্যের স্থানে তুলে আনতে পেরেছেন।
আরো কিছু তথ্য:
সাহিত্যে নোবেল পাওয়া প্রথম ফরাসি নারী অ্যানি এরনোর বয়স ৮২ বছর। লিখছেন ৪০ বছর ধরে। তার বেশ কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাস রয়েছে। অনেকগুলোই আধা–আত্মজীবনীমূলক। প্রথম বই ‘লে আখঁমখে ভিদ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৯০ সালে ‘ক্লিনড আউট’ নামে বইটির ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৩ সালে উপন্যাস ‘লা প্লাস’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ‘আ ম্যানস প্যালেস’ শিরোনামে। এই উপন্যাস বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পায়।
অ্যানি এরনোর ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, জন্ম ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলের নরমান্ডিতে। তিনি যে পরিবেশে শৈশব কাটিয়েছেন, তা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত তবে উচ্চাভিলাষী। তাঁর মা–বাবা একটি ক্যাফে ও মুদিদোকান চালাতেন। যখন তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মেয়েদের মুখোমুখি হতেন, সে সময় খেটে খাওয়া শ্রেণির মা–বাবা ও নিজেদের পরিবেশের জন্য তাঁকে লজ্জা দেওয়া হতো।
সাহিত্যে পড়াশোনা করেছেন। লন্ডনে শিশু লালনপালনের কাজও করেছেন তিনি। বিবাহিত এরনো দুই সন্তানের মা।
আনি এরনো ১৯৬৪ সালে গর্ভপাত করেছিলেন। সে সময় তাঁর দেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ ছিল। পরিবারের কাছ থেকেও বিষয়টি গোপন করেছিলেন তিনি। এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি লিখেছিলেন প্রথম উপন্যাস ‘ক্লিনড আউট’। এর ২৫ বছর পর তাঁর বই হ্যাপেনিং লেখার সময়ও ওই অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা তুলে আনেন তিনি। তার এই বই নিয়ে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছিল। গত বছর ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে সেটি শীর্ষ পুরস্কার পায়।
এরনোর বই ‘দ্য ইয়ার্স’ ২০০৮ সালে ফ্রান্সের প্রি রেনোদোঁ এবং ২০১৬ সালে ইতালির প্রিমিও স্ট্রেজা পুরস্কার পায়। এর পরের বছর মার্গারেটে ইয়োরকেনার পুরস্কার লাভ করেন আনি এরনো।
২০১৯ সালে ম্যান বুকার পুরস্কারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিল ‘দ্য ইয়ার্স’। এই গ্রন্থকে ফরাসি জীবনের স্মৃতিচারণার ‘মাস্টারপিস’ বলেন সাহিত্য সমালোচকেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী দ্য নিউইয়র্কার ২০২০ সালে লিখেছিল, আনি এরনো তাঁর ২০টির বেশি বইয়ে শুধু একটি কাজ করেছেন: নিজের জীবনের খুঁটিনাটি তুলে আনা।