শাহ মতিন টিপু
জন্মের পরই তাঁর মুখ থেকে প্রথম যে শব্দটি বেরোয়, সেটি ‘পিজ’। পুরো কথাটি হল ‘লাবিজ’, স্প্যানিশ এই শব্দের মানে হল পেনসিল। বাস্তবিকই, ছোটো থেকেই পিকাসোর হাতে উঠে গিয়েছিল পেনসিল, ইজেল, ক্যানভাস। ছিল রঙের দুনিয়া; বাকি সরঞ্জাম বলতে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ আর কল্পনা। মৃত্যু সবসময় তাঁর গায়ে আঁচড় কেটেছে। সে প্রিয় বোনের অকালমৃত্যুই হোক, বা প্রেমে আঘাত পেয়ে বন্ধুর আত্মহত্যাই হোক। জীবন একসময় ছিল নানা রঙে রঙিন; সেখানেই ফুটে উঠল দুটো রং— নীল আর কালো। তারপর আবারও বাঁক পরিবর্তন হয়েছে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, পিকাসোর জীবনের এই বাঁক বদল যখনই হয়েছে, তখনই বদলে গেছে ক্যানভাসের রং। কখনও উজ্জ্বল, কখনও গভীর বিষাদের মতো। জীবনটাই যে আস্ত চিত্রনাট্য। আর পিকাসো তো শুধু সেটার ওপরেই তুলি বোলাচ্ছেন!
বিশ্বখ্যাত স্পেনের চিত্রশিল্পী ও ভাস্কর পাবলো পিকাসোকে কে না জানে। বিংশ শতাব্দীর সেরা চিত্রকরদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জন্মসূত্রে স্পেনীয় হলেও জীবনের একটা বড় অংশ ফ্রান্সে কাটিয়েছেন। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে উত্তর আধুনিকতার জনক বলা যায় তাকে। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে কাজ করে বিশ্বের চারুকলাকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।
পাবলো পিকাসোর ১৪২তম জন্মদিন আজ। ১৮৮১ সালের ২৫ অক্টোবর তার জন্ম। বাবা রুইজও চিত্রশিল্পী ছিলেন। পাখির ছবি আঁকাই তার বিশেষত্ব ছিলো। তিনি চারুকলা বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং যাদুঘরের তত্বাবধায়ক ছিলেন। এই রঙ তুলির পরিবেশে বেড়ে ওঠায় খুব ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ জন্মে তার। মাত্র ৭ বছর বয়সেই পিকাসো বাবার কাছ থেকে প্রাণিশরীর অঙ্কন এবং তৈলচিত্রের প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ৯ বছর বয়সেই তিনি সম্পূর্ণ তৈলচিত্র এঁকেছিলেন। বাবা তার পিকাসোর এই অসামান্য প্রতিভাকে চিনেছিলেন এবং যত্নসহকারে লালন করেছিলেন। ফিগার ড্রইং এবং তৈলচিত্রের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি তার বাবার কাছেই।
কথিত আছে, পিকাসো সাধারণত রাত দশটা-এগারোটা থেকে আঁকা শুরু করতেন। চলত সারা রাত। একের পর এক অসাধারণ সৃষ্টি করে গিয়েছেন। অসম্ভব জীবনীশক্তি নিয়ে জীবনের শেষ দিন অবধি শিল্পচর্চা করে গিয়েছেন।
তিনি চরম দারিদ্রের মধ্যেও রেস্তোরাঁয় খেতে আসা রুগ্ন, জীর্ণ চেহারার গরিব মানুষের ছবি আঁকতেন। এ ছবিগুলো ছিল মূলত নীল রঙে আঁকা। তখন থেকেই তিনি পরিচিত হতে শুরু করেন। শিল্পমাধ্যমের ওপর তার ক্ষমতা, প্রতিভা স্বীকৃতি পেতে থাকে।
পিকাসোর একটি বিখ্যাত ছবি ‘উইপিং উওম্যান’। সেই সময় প্রেমিকা ডোরা মার-এর সঙ্গে পিকাসোর বিচ্ছেদ ঘটছে, তিনি অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ডোরা’র কান্নামাখা বিকৃত মুখের ছবি আঁকলেন তিনি। শুধু ইনিই নন, পিকাসোর জীবনে অনেক নারী এসেছেন এবং প্রত্যেকেই তার শিল্পকাজকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেন। তাদের সংস্পর্শে এসে প্রচুর ছবি তিনি এঁকেছিলেন। অদ্ভুত শিল্পকীর্তির জন্ম দিয়েছিলেন। শেষ জীবনটা যার সঙ্গে কাটিয়েছিলেন, সেই জ্যাকেলিন নিজেও ছিলেন পিকাসোর অনেক ছবির মডেল।
স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে তার বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্মটি হচ্ছে ‘দেমোইসেল্লেস দ্য’অ্যাভিগনন’ ও ‘গোয়ের্নিকা’। বলা হয়- যত দিন মানুষ, স্বাধীনতার স্পৃহা, অগ্রগামী চিন্তাচেতনা বেঁচে থাকবে, তত দিন গোয়ের্নিকা বেঁচে থাকবে।
চিত্রটির পটভূমি হচ্ছে স্পেনের ব্যস্ক কান্ট্রির গোয়ের্নিকা নামক শহরটিতে স্প্যানিশ সিভিল ওয়ারের সময় জার্মান ও ইতালিয়ান যুদ্ধবিমানের বোমাবর্ষণ। স্প্যানিশ ন্যাশনালিস্টদের কমান্ডেই তারা এই বোম্বিংটা করে। গোয়ের্নিকা ছিলো রিপাবলিকান চেতনা ও ব্যঙ্গ সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। তাই ন্যাশনালিস্টরা এই শহর ধ্বংসের জন্য উন্মত্ত ছিলো।
পিকাসোর উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে- ল্যা মুল্যাঁ দা ল গালেৎ, দ্য ব্লু রুম, ওল্ড গিটারিস্ট, দ্য উইপিং ওম্যান, লেস ডেমোঁয়সেলেস ডি’এভিগনন, সেলফ-পোর্ট্রেট, টু নুডস, আভাগঁর রমণীরা, থ্রি মিউজিশিয়ানস, স্কাল্পটর, মডেল অ্যান্ড ফিশবৌল, থ্রি ড্যান্সার্স, গিটার, গ্লাস অব আবস্যাঁৎ, সিটেড বাথার, পালোমা ও গোয়ের্নিকা।