ঐতিহ্যের সেই গ্রামোফোন নেই, নেই ভাওয়াইয়া সম্রাট

শাহ মতিন টিপু

 

‘ওকি গাড়িয়াল ভাই/ কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’-আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে এমন দরদমাখা গান শুনে প্রথম মোহিত হয়েছিলেন বাংলার মানুষ। যে গান একসময় গ্রামোফোন রেকর্ডে শোনা যেতো দিবানিশি।

আজ ঐতিহ্যের সেই গ্রামোফোন নেই, নেই ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাসউদ্দীন। তবে আজো যার গান হয়ে আছে চিরন্তন। ভাওয়াইয়া সম্রাটের ১২২তম জন্মদিন আজ।

৯০১ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে জন্মগ্রহণ করেন। তার দরদি কণ্ঠে গাওয়া পল্লিগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। গানের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলিম মানসে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন।

আব্বাসউদ্দীন ছিলেন মূলত স্বশিক্ষিত গায়ক। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বিচ্ছেদি, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, পালাগান ইত্যাদি পল্লিগানের নানা শাখার গান গেয়ে ও সেসব গান রেকর্ড করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদদীন ও গোলাম মোস্তফার ইসলামী ভাবধারায় রচিত অনেক গানও গেয়েছেন।

তিনি যখন গান শুরু করেন সময়টা ছিল বাংলার মুসলমান সমাজের নবজাগরণের কাল। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব স্নেহ করতেন তাকে। কবি সবার কাছে আব্বাসউদ্দীনকে পরিচয় দিতেন ‘আমার ছোটভাই’ বলে। প্রায় ২০ বছর তিনি কবি নজরুলের সাহচর্যে ছিলেন।

যে কোনো গান শোনা মাত্র তিনি সুমধুর কণ্ঠে আয়ত্তে নিতে পারতেন আব্বাসউদ্দীন। জাতীয় কবির বিখ্যাত গান ‘ও মন রমজানেরই রোজার শেষে…’ গানটি প্রথম গেয়েছিলেন তিনি।

কলকাতায় বেড়াতে এসে আব্বাসউদ্দীন গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ডে গান গাওয়ার সুযোগ পান। প্রথম রেকর্ড করা শৈলেন রায়ের লেখা `স্মরণপারের ওগো প্রিয়` এবং `কোন বিরহীর নয়ন জলে` দু`টি গানই জনপ্রিয় হয়। তিনি কুচবিহার থেকে কলকাতায় চলে আসেন।

পাকিস্তান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আব্বাসউদ্দিন ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট রাত ১২টার পর ঢাকা বেতার থেকে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সেই থেকে ঢাকায় নতুন করে তার জীবন শুরু।

তিনি একজন অভিনেতাও। তিনি চারটি বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। এগুলো হলো-‘বিষ্ণুমায়া’ (১৯৩২), ‘মহানিশা’ (১৯৩৬), ‘একটি কথা’ এবং ‘ঠিকাদার’ (১৯৪০)। ঠিকাদার ছবিতে আব্বাসউদ্দীন একজন কুলির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এসব সিনেমায় তিনি গানও করেছিলেন।

আব্বাসউদ্দীনের রেকর্ড করা গানের সংখ্যা প্রায় ৭০০। ‘ও কী গাড়িয়াল ভাই’, ‘তোরষা নদী উথাল পাতাল, ‘কারবা চলে নাও’, ‘প্রেম জানে না রসিক কালাচান’, ‘মাঝি বাইয়া যাও’, ‘নাও ছাড়িয়া দে’, ‘ওই শোন কদম্বতলে’, ‘ও ঢেউ খেলেরে’, ‘নদীর কূল নাই’, ‘একবার আসিয়া সোনার’, ‘আল্লাহ মেঘ দে’, ‘আমায় এত রাতে কেন ডাক দিলি’, ‘ও কী ও বন্ধু কাজল ভোমরারে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের কণ্ঠশিল্পী এই মরমিশিল্পী।

পল্লীগানের এই সম্রাট ১৯৫৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

 

Print Friendly

Related Posts