গুলশান-ই-ইয়াসমীন এর ধারাবাহিক ফিকশন ॥ পর্ব ৬-১০

পর্ব-৬

সাথে সাথে রূপ রেখা সন্ধ্যার সময়কার ফসিলে রূপ নিল। রাতের আকাশ নিঝুম পরিবেশে রূপ রেখার ফসিল মূর্তি দেখে তুয়া ভয় পেয়ে গেল। হাতে ধরা যাদুর পাথরের সাহায্যে তুয়া চিৎকার করে বলে, আমাকে সাহায্য করো। সাথে সাথে বিশাল গর্জনসহ বাতাসে একটি ভেলার মাঝে উপস্থিতি টের পেল। ভেলাটি যেন উড়ে উড়ে ছোট একটি পাহাড়ে এল। পাহাড়ে ভেলাটি এক পাশে দাঁড় করলো। সাথে সাথে চারদিক হাওয়া স্তব্দ সুন্দর পরিবেশ হাজির হলো।

অজস্র আলো বাতির মধ্যে দিয়ে রাজার আসনে রাজা বসে আছেন। তার পাশে এক ধারে রাণী অন্য ধারে প্রজা সৈন্য সামন্ত। কিন্তু কোন মানুষ প্রতিকৃতি না। কাঠ বিড়ালের মতো কিন্তু গড়ন মানুষের প্রতিকৃতি। অদৃশ্য থেকে রূপ রেখা বলে, এই রাজা ভাল রাজা। আমাকে যখন যাদুর পাথর দেওয়া হয় তখন বুড়িমা বলে, কোন একদিন বিজ্ঞানী ফসিল নামক এক রাজার যদি দেখা হয় তবে বুঝবি সে কেমন অসৎ ও শয়তান। সেই রাজাকে সৎ ও ভালো করার দায়িত্ব সকল ভালো মানুষের। বুড়ি মা বলেছিল-

“বিজ্ঞানী ফসিল রাজা-

করবি মাছ ভাজা,

দিবি তারে সাজা-

বিজ্ঞানী ফসিল রাজা।”

তুয়ার মনে হলো এই রাজাতো বুড়িমার সেই বিজ্ঞানী ফসিল রাজা না। তুয়ার মনে কেমন একটা ভাব হলো- এ রাজা সে রাজা নয়। এ কোন অন্য রাজা। এদের আচার ব্যবহার কথাবার্তা কেমন যেন মানুষের কাছাকাছি। অতি ভদ্র সভ্য। এদের অত্যাচারী মনে হলো না। এদের রাজ্যে যেন পরম শান্তি বিদ্যমান তবে এদের স্বভাব তুয়ার এখনও জানা নেই। কোন মানুষ কিংবা জীবের সাথে না মিশলে তাদের আচরণ সম্পর্কে জানা যায় না। রূপ রেখাকে যাদুর বুড়ি বলে ছিল, বিজ্ঞানী ফসিল খুব শয়তান মানুষ । কিন্তু এই রাজ্যের সব কিছু  যেন শান্তিপূর্ণ। এতো শান্তি থাকলে শয়তান মানুষগুলো কোথায় থেকে রক্ষা করা যাবে। আর তাই তুয়া মনি ভিতরে কৌতূহলী হয়ে উঠে। ভাবে কোথায় গিয়ে বিজ্ঞানী ফসিল এর সন্ধান মিলবে? তুয়া মনি বারে বারে ভাবে, বিজ্ঞানী ফসিলকে অনুসন্ধান করার জন্য সন্ধানী হয়ে উঠে।

সে রূপ রেখাকে বলে, অজানাকে জানার রহস্যে রূপ রেখার সাহায্য আজ যেন প্রস্ফূটিত হয়ে যায়। দূর অজানার গ্রহ-উপগ্রহ বিজ্ঞানী বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে আবিষ্কার করে। তুয়ার হাতে বিজ্ঞানী ফসিল আবিষ্কার আপাতত রূপ রেখা ফসিল ও পাথর টুকরো। এই পাথর টুকরোকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সবচেয়ে দুষ্টু লোকের খোঁজে।

 

পর্ব-৭

তুয়া মনি একটু ভয় পেলো না। সে মানুষের মতো করেই বলে, আপনারা কে?

রাজা বলে উঠে, আমরা বহু যুগ আগের বাসিন্দা। আমাদেরই একজনের ফসিল তোমাদের বাগানে আছে। এক সময় আমাদেরও মুখ দিয়ে আগুন বের হতো, যা বর্তমানে অনেক কমে গেছে।

তুয়া মনি অবাক হয়ে বলে, আপনারা কি বলছেন?

রাজা বলে, হ্যাঁ আমাদের পৃথিবীতে আমরা যারা স্বাধীন জীব আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি। তবে বাংলা ভাষা নানা অঞ্চলে নানা সময়ে একটু পরিবর্তন হয়। আমাদের এই বর্তমান সময়ে বাংলা বেশ ভালভাবে পরিবেশন করতে থাকি। দূরে থেকে বিভিন্ন রকম আওয়াজ কানে আসতে থাকে। তুয়ার যদিও ভয় লাগে তবুও ভয় পেতে চায় না। দূরে অজানাকে তার জানতে ইচ্ছে করে।

রাজার কয়েকজন নারী সৈন্য এসে বলে, আপনি আসুন আমাদের বাংলোতে খুব সুন্দর সম্মান প্রদান করা হবে আপনাকে। তুয়া মনি ভয় পেয়ে যায়। মনে মনে খোঁজে রূপ রেখাকে। কিন্তু পায় না। যখন নারী সৈন্য তুয়াকে সম্মান প্রদর্শন করতে চায় তখন তুয়া মনে মনে কেন জানি ভয় পেয়ে যায়। আজ যদিও বড় আনন্দ আর জয়ের দিন তুয়ার তথাপি মনের মাঝে সত্যিকারে আনন্দ খুঁজে পায় না। মনের মাঝে এক অশান্তি আর ভয় যেন কাজ করছে। এই রাজাতো বিজ্ঞানী ফসিল না। বিজ্ঞানী ফসিল বড্ড ভয়ংকর এক পাষন্ড। এদের মাঝে কোন বিজ্ঞানীরূপী ফসিল নেইতো। একসময় তুয়া বলে ফেলে আপনাদের দেশে কি বিজ্ঞানী ফসিল নামক কেহ আছেন?

মহিলা সৈন্য সুন্দর করে বলেন- না, আমাদের দেশে রাজার নাম জুনান বো। তুয়া এতক্ষণে মনে খুশি আসে। নতুন আচার-আচারণ সাংস্কৃতিক কর্ম  কান্ড খুবই ভালো লাগে। এদের সমাজ সজ্জা বাংলাদেশের মতো। বাংলাদেশ থেকে বহু দূরে হলেও মনের কোণে বাংলাদেশের ঢেউ খেলে যায়। দেশের প্রশাসনের দ্বায়-দায়িত্ব খুবই সুন্দর। ঠিক যেন বাংলাদেশের মতো। নিজের দেশের শান্তির দিকগুলো তুলে ধরতে কতই না আনন্দ।  দেশের শান্তির নীরব কর্ম-কান্ড তুয়ার কাছে খুব ভালো লাগে। এদের নিয়ম-কানুন মনে হয় নিরব ইশারার মধ্যে সংঘটিত হয়।

মহিলা সৈন্যটি তুয়ার নাম জিজ্ঞাসা করে বলে, আপনার নাম কি?

তুয়া বলে, আমার নাম তুয়া মনি।

মহিলাটি খুশি হয়ে যায় বলে, তোমার নাম ব্রেভী গার্ল বললে ভাল হতো। তোমার নামটির মধ্যে আদর ভাবটা বেশি কিন্তু তুমি অনেক সাহসী। তাই ব্রেভী গার্ল হওয়া উচিত ছিল।

তুয়া মুখটি আছরী করে বলে, আমার বাবা, মা ও নানী বলে থাকেন আমি অনেক সাহসী নাকি। আর তাই উনারা আমাকে সাহসী বলে অভিহিত করেন। এই সাহস নিয়ে শয়তান বিজ্ঞানী ফসিলকে ধরতে চাই। বিজ্ঞানী ফসিল অনেক বেশি যেন অত্যাচার করেছে দেশে।

 

পর্ব-৮

অনেক মেয়েরা ওর আশে-পাশে থাকে। ওদের ধরণ ধারণ যেন মেয়েদের মতো। ওদের বাড়ী মানুষের বাড়ী থেকে একটু আলাদা। তবে তুয়া মনি খেয়াল করে ওর কোন ক্ষুধা ও নিদ্রা নেই। কতক্ষণ হলো এখানে এসেছে তাও জানে না। সুরেলা গানের  পরিবেশের মধ্যে দিয়ে রানী চলে আসে। স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, তোমার ভয় লাগছে নাতো? তুয়া মনি অনেক শক্তি সঞ্চার করে বলে, না। আমি নতুন পরিবেশ দেখতে পাচ্ছি। নতুন পরিবেশে কিন্তু বাংলা ভাষা আমার প্রাণের ভাষা। আমার প্রাণের ভাষা এখানেও শোনা যাচ্ছে। বহুত কঠিন।

রানী হেসে বলে, ওরে বাংলা ভাষা আমাদেরও প্রাণের ভাষা। এ ভাষায় আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। আমরা যখন ঘুমাই হঠাৎ করে চারদিকে ভীষণ শব্দ হয়। অনেক ছোট ছোট ডাইনোসর এদিক দিয়ে আসে। গাছ পালা পুড়িয়ে দেয়। ঘর বাড়ী জঙ্গল সব কিছু পুড়িয়ে দেয়। ভিন রাজ্যে ভিন দেশীরা যাদের অঙ্গ থেকে আগুন বের হয় তারা আগুন দিতে চায় না। বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে সেখানে। তুয়া এসেছে, মনের মাঝে শান্তির ঢেউ খেলে যায়। দূর দূরান্তে যেন বাঙ্গালীপনার মিঠে সুর ভেসে যায়। সবাই মিলে শান্তির গান গায়। কিন্তু রূপ রেখা বিজ্ঞানী ফসিল এর নাম কেন উঠলো? এখনও দেখা মিলে নাই। তবে কি বিজ্ঞানী ফসিল রূপ রেখার চাওয়া পাওয়ার বাহিরে। বিজ্ঞানী ফসিল বলতে কিছু নেই। রূপ রেখা বলেছে, বিজ্ঞানী ফসিলকে ভালো করতে হবে। বিজ্ঞানী ফসিল অত্যন্ত অত্যাচারী। তাকে ঠিক করার জন্য রূপ রেখাকে যাদুর পাথর দেওয়া হয়েছে। অতএব তাকে ঠিক করতে হবে।

 

পর্ব-৯

উপায় নেই দেখে তুয়া পাথরের সাদা কোনে বাংলা ভাষা চায়। সাথে সাথে বাংলা ভাষার অক্ষর অ, আ, ই ঈ, ক, খ ইত্যাদি চলে আসে। তার সাথে বাংলা মায়ের ছবি আসে। তুয়া মনি ছোট ছোট ডাইনোসরের মুখের আগুনের মাঝখানে বাংলা অক্ষর ছড়িয়ে দেয়।  ছোট ছোট ডাইনোসরগুলি বাবাগো মাগো বলে সব মুখ বন্ধ করে। ছোট ছোট ডাইনোসরগুলো মুখ দিয়ে  আগুন বের করে না। বলে, আমরা আগুন দেব না। আগুন দেব না।

তুয়া মনি অনেক খুশি হয়ে বলে, আমার মা তোমার মা বাংলা কথা বলে। বাংলা আমার প্রাণের ভাষা। এই দূর রাজ্যে সবার সাথে বাংলা ভাষায় কথা বলে তুয়া তৃপ্ত হয়। ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়। চারদিকে বাংলা ভাষাভাষীর মানুষ কথা বলে। ছন্দে ছন্দে ছড়া কাটে। এখানে বাংলা ভাষাকে পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডাইনোসরের মুখ দিয়ে আগুন বের হয় না। পৃথিবীর এমন সুন্দর পরিবেশ আর কোথায় আছে। তুয়ার বাংলা ভাষার জন্য মমত্ববোধ আরো বেড়ে যায়। দূর-দূরান্তে বাংলা কথা ভাবা যায় না। তুয়া রূপ রেখার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ জাগ্রত হয়। রূপ রেখা যাদুর পাথরসহ অনেক কিছু যেন শিখিয়ে দিয়েছে। বাংলা ডাকে প্রথম কথা বলে মায়ের সাথে বাবার সাথে। সেই ভাষা নিয়ে বাংলাদেশে যুদ্ধ হয়েছিল। ভাষার জন্য সালাম, বরকত, রফিক মারা যায়। সেই ভাষার জন্য চারদিকে কত আন্দোলন হয়েছিল। এদেশের ডাইনোসরদের মুখ দিয়ে আগুন বের হতো। কিন্তু বাংলা ভাষাকে শ্রদ্ধা করে আগুন বের হয় নাই। তুয়ার কাছে ব্যাপারটা খুব ভাল লাগছে। দেশে ফিরলে সবাইকে গিয়ে বলবে এই ঘটনা বাংলা ভাষার প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা।

 

পর্ব-১০

তুয়া মনির মনে হচ্ছিল ও এতক্ষণে নিজ দেশে  নিজ পরিবেশে আছে। নানী আম্মু ভাই বোন সবাই যেন কাছে আছে। হঠাৎ করে ওর আশে পাশে জীবন্ত সব কিছু যেন অম্লান হয়ে গেল। তুয়া অবাক হয়ে গেল। তুয়া আলো ছায়ার মধ্যে দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ। পথ দিয়ে তুয়া এগুতে থাকে। সামনে একটা বিরাট কায় ঘর। ঘরের দেয়ালে নানা রকম আঁকা বাকা। এই মুহুর্তে রূপ রেখাকে মনে পড়ে। মনে পড়ে রূপ রেখা দৈব শক্তির কথা আর তাই রূপ রেখকে মনে করে বলতে থাকে-

“রূপ রেখা, রূপ রেখা

চারদিকে আঁকা বাকা

কিন্তু আমি একা

আমি একা।”

রূপ রেখার বাণী যেন আকশে ছোঁয়া বাণী হয়ে এলো।

“আমি ঐ রূপ রেখা

রূপ রেখা-

ছাদের দিকে তুই তাকা

তাকা তুই তাকা।”

অদ্ভুত দেশে তুয়া এসেছে। আর ইদানিং মাঝে মাঝে রূপ রেখার সাথে সাথে তুয়া মনি যেন কবিতার ছন্দে কথা বলে। প্রায়ই অনেকে ছন্দ দিয়ে কথা বলে যা খুব ভাল লাগে। মনে রস বোধ হয়। কৌতূহল সন্ধান এগুলো তো আছে। এর মাঝে রস বোধের যেন উদয় হয়েছে। চারদিক থেকে এক অজানা ছন্দ যেন দুলে যাচ্ছে।

 

(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts