মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপন : এখনই সময়

বিদ্যমান শুল্ক কাঠামো পরিবর্তন জরুরী

বিডিমেট্রোনিউজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মোবাইল ফোন সেট কারখানা স্থাপন করলেও বাংলাদেশে এখনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেই। বছরে আড়াই থেকে প্রায় ৩ কোটি মোবাইল সেট বিক্রি হলেও বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। এর প্রায় সবটাই আসে চীন থেকে।

অর্থনীতিবিদ, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট কারখানা স্থাপনের এখনই সময়। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সঠিক শুল্ক ও কর নীতিমালা প্রণয়ন। তারা সরকার তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে এ বিষয়ে অতি দ্রুত উদ্যোগ নিতে বলছেন।

বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোতে ফিনিশড বা সম্পূর্ন তৈরি মোবাইল হ্যান্ডসেট আদমানিতে ভ্যাট, কাস্টমস, এআইটিসহ শুল্ক দিতে হয় সাকুল্যে ২৩.৭৫ শতাংশ। অথচ হ্যান্ডসেটের মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় সর্বোচ্চ ৯৫ শতাংশ। প্রয়োজন হয় প্রায় ৯০ টি কাঁচামাল। এর মধ্যে ব্যাটারিতে ৫৩.৩৫ শতাংশ, পিসিবি (প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড) বা মাদারবোর্ডে ৩১.৫০ শতাংশ, এলসিডি ডিভাইসে ৩১.৫ শতাংশ, ইয়ারফোনের উপর ৫৩.৩৫ শতাংশ এবং স্ক্র ভয়েড স্টিকার আমদানিতে প্রায় ৯৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। অর্থাৎ পরিপূর্ণ মোবাইল ফোন আমদানির তুলনায় কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি করলে শুল্ক দিতে হয় প্রায় দ্বিগুণ।

mobile-1

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ফোন তৈরির জন্য সাধারণ মানের একটি কারখানা করতেও প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ দরকার। প্রয়োজন প্রায় ২৩ ধরনের ভারি মেশিনারিজ। কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান মোবাইল ফোন তৈরির চিন্তা ভাবনা করছে। তাদের কেউ কেউ অবকাঠামো নির্মাণ এমনকি সীমিত পরিসরে মেশিনারিজ স্থাপনও করেছেন। এখন অপেক্ষা করছেন সরকারের নীতি সহায়তার। তাদের মতে, বিশাল অংকের বিনিয়োগ করে উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। আগে নীতিমালা হোক, তারপর বিনিয়োগ।

প্রস্তাবিত কম্পিউটার এ্যান্ড মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স এ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এ্যাসোসিয়েশন দাবি করেছে এই শিল্পের অনকূলে এসআরও (স্ট্যাচুটরি রেগুলেটরি অর্ডার) জারির মাধ্যমে দশ বছরের জন্য শুল্ক রেয়াত দেয়া হোক। সেইসঙ্গে মোবাইল ফোন উৎপাদনে ব্যবহৃত মৌলিক কাঁচামাল এবং যেসব যন্ত্রাংশ প্রাথমিকভাবে দেশে উৎপাদন সম্ভব নয় তার উপর আমদানি শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক। স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিও করা হয়েছে।

বাস্তবতা হলো, এখনই উদ্যোগ না নিলে এ শিল্পের বিশ্ব প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়বে বাংলাদেশ।  বিষয়টি উপলব্ধি করে গত ১৬ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। ‘দেশীয় উদ্যোগে মোবাইল ফোন শিল্প গড়ে তোলার এখনই উপযুক্ত সময়‘ শীর্ষক আলোচনায় এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা পদ্মা সেতু নির্মান করতে পারলে মোবাইল ফোন কেন তৈরি করতে পারব না।’ এ খাতে সরকার বিনিয়োগ বান্ধব নীতি প্রনয়ন করলে তিনি নিজেই মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপনের ঘোষণা দেন।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে বলে দেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কিন্তু আমদানি দিয়েই পুরো চাহিদা মেটানো হচ্ছে। গার্মেন্টস দিয়ে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আনলেও মোবাইল ফোন কিনতে সে মুদ্রা আবার চলে যায়। দেশে ফোন তৈরি হলে এই মুদ্রা সাশ্রয় হতো। তিনি বলেন, সরকারের প্রয়োজনীয় নীতি সহযোগিতা পেলে দেশে খুব শিগগীরই মোবাইল ফোন শিল্পের বিকাশ হবে।

এফবিসিসিআইয়ের বর্তমান সভাপতি মাতলুব আহমেদ বলেন, ভারত ও ভিয়েতনাম যদি মোবাইল ফোন উৎপাদন করতে পারে, আমরা কেন পারব না। দোষ আমাদের, আমরা আমদানি করতে ভালোবাসি। তবে বাংলাদেশে শিল্পের জোয়ার বইছে। মোবাইল ফোনের মতো ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তিনি এ বিষয়ে এনবিআরের কাছে শুল্ক ও কর সহযোগিতা চান।

উল্লেখ্য, ভারতে মোবাইল ফোন আমদানির উপর ১৭.৯৭ শতাংশ শুল্কারোপ রয়েছে। অন্যদিকে কাঁচামাল আমদানির উপর গড় শুল্কহার দুই শতাংশেরও কম! তারা এ শিল্পের জন্য পরিকল্পিতভাবে ৩০ বছরের ট্যাক্স হলিডে ঘোষণা করেছে। ভিয়েতনামের কথা বলাই বাহুল্য। একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি বিনিয়োগ এবং পর্যাপ্ত শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়েছে অনেক দূর। মোবাইল ফোন ওইএম (অরিজিনাল ইক্যুয়েপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার) করেও তারা আয় করছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন, এটা একটা ব্যতিক্রমী শুল্কনীতি। ফিনিশড প্রোডাক্টের তুলনায় কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক অবশ্যই কম হতে হবে। তা না হলে এ্যাসেম্বলিং বা ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানা গড়ে উঠবে না।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ এ খাতের বিদ্যমান শুল্কনীতিকে কা-জ্ঞানহীন বলে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এ ধরনের শুল্ক বৈষম্য আমদানিকারকদের স্বার্থ রক্ষা করছে। সাধারনত যে কোনো ক্ষেত্রে ফিনিশড গুডস এর আমদানিশুল্ক যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের চেয়ে অবশ্যই বেশি হতে হবে। অন্যথায় কেউ ঝুঁকি নিয়ে এই শিল্পে বিনিয়োগ করবে না। যারা এখন উদ্যোগ নিতে চাইছেন তাদের সুযোগ দেয়া উচিত। মৌলিক কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক যৌক্তিক হলে দেশে এ শিল্প গড়ে উঠবে।

আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং না হলেও বেশ কিছু স্থানীয় ব্র্যান্ড এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। বিদেশী ব্র্যান্ডকে হটিয়ে বাংলাদেশী ব্র্যান্ডই এখন মার্কেট লিডার। এরমধ্যে রয়েছে ওয়ালটন, সিম্ফনি, ওকাপিয়া ও এলিট। বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি। এদের বেশির ভাগই ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন মোবাইলের মাধ্যমে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি হলে লাভবান হবে সরকার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং জনগণ। কারণ বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। রপ্তানি আয় বাড়বে। ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনবল তৈরি হবে। আনুষঙ্গিক ব্যাকওয়ার্ড শিল্প গড়ে উঠবে। সর্বোপরি ফোন ব্যবহারকারীরা সাশ্রয়ী মূল্যে পাবেন উন্নত মানের ’মেইড ইন বাংলাদেশ’ হ্যান্ডসেট।

Print Friendly, PDF & Email

Related Posts